Sunday, June 9, 2019

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি






 ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না
মৃত্যু শোক অপযশ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন মনের ভেতরে ধাক্কা খেল? এই প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছেও নেই।
‘ভাঙাগড়ার খেলা’ শব্দবন্ধটি বহুল ব্যবহৃত। ভাঙতে ভাঙতে যা গড়ে ওঠে তা কখনও সৃষ্টি তবে মনের ভেঙে যাওয়ায় যে ক্ষয় নিহিত রয়েছে এতে সৃষ্টিকর্তাকে ক্রমাগত ব্যথাতুর পথে ভ্রমণ করতে বাধ্য করে। ‘ভেঙে যাওয়ার পরে’ উপন্যাসে কবি ও শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক জয় গোস্বামী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অখিলেশকেও ক্রমাগত এই ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছেন এবং শেষপর্যন্ত অখিলেশ ভেঙে পড়েন নি। তাই ভেঙে পড়েন নি পাঠক। যে যেভাবেই উপন্যাসটি পাঠ করি না কেন, একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে এসে অখিলেশের সাথে সাথে পাঠকেরও শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়। প্রেম শেষপর্যন্ত কোথাও ঝুঁকে পড়ে না। ঝুঁকে পড়তে দেয় না এর ধারককেও।

‘হারিয়ে যাওয়া লাটিম আমি তোমার কথা ভাবি
ঠিক তোমার নয় তোমার হারিয়ে যাওয়ার কথা’
আলোক সরকারের ‘হারিয়ে যাওয়া লাটিম’ কবিতাটা মনে পড়ছিল।
জয় গোস্বামী তাঁর উপন্যাসে হারিয়ে যাওয়ার কথাটাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। বৃদ্ধ কবি অখিলেশ তাঁর প্রেম অথবা নিবিষ্ট পাঠক পেয়েছিলেন। কিন্তু ভেঙে যাওয়া অথবা এই হারিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন অনুষঙ্গ তাঁর মনে আসত। বেশ কিছু শব্দ যা ওই মেয়েটি ব্যবহার করতেন যেমন, ‘উবর’ ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘গীতাঞ্জলী’, ‘এক্সপার্ট’ ইত্যাদি। শব্দগুলো তাঁর কানে এলেই কি মানসপটে কিছু স্মৃতির ক্যানভাস ফুটে উঠত? তাই তিনি কষ্ট পেতেন? আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বন্ধুতার ভরসায়, শুশুর্ষার আশায় স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু শুশুর্ষা হয়ত সেখানেও প্রয়োজন ছিল। ভাঙন শুধু এক পাড় নয় অনেকটা বিস্তৃত অংশ জুড়েই হয়। ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে তাঁর হয়ত সেই হারিয়ে যাওয়ার কথাই মনে পড়ছিল।
‘ছিলে একদিন সারাবেলা উদ্বেগব্যাকুল নিশীথিনী
ঠিক কখন হারিয়ে গেলে লাল রঙের লাটিম?
কত নিঃশব্দে হারিয়ে গেলে!’
হারানোর শব্দ হলেও কি হারানো আটকানো যেতো? এই প্রশ্ন বারবার মনে আসে।
‘দি-ই-ন’ বলে পূর্ণ চোখে তাকানোর মধ্যে, নিবিষ্ট ভাবে লেখা কপি করার মধ্যে কখনও গীতাঞ্জলী খুলে রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যাখ্যার মধ্যেও একবার হারিয়ে গিয়েছিলেন অখিলেশ। ফ্রয়েডিয়ান হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে যৌনস্মৃতি মিশে আছে এই হারিয়ে যাওয়ায় একবারও সেকথা মনে আসে নি। তবে কি যৌনতা বর্জিত সেই হারিয়ে যাওয়া। যাকে প্লেটোনিক প্রেম বলে মনে হবে পাঠকের?
‘পূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকাটাই সম্পর্ক বা স্ফুলিঙ্গ।’ এই সামান্য কয়েকটা শব্দের মধ্যে দিয়েই যাবতীয় প্রেম, যৌনতা অথবা প্রগাঢ় অনুভূতি ধরা দেয়। শুধু সম্পর্কের ভেঙে যাওয়াই নয়, প্রচলিত ভাবনার গভীরে খুব স্পষ্ঠ অথচ সূক্ষ্মভাবে পাঠককেও আঘাত করে। ভেঙে দেয় যাবতীয় মিথ। রবীন্দ্রগানের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় যে আসলে গানটাই হারিয়ে যেতে পারে, তাত্ত্বিক বা বৌদ্ধিক ব্যাখ্যা শ্রোতার মনে কঠিন কর্কশ গদ্যের রেশ এনে দিতে পারে একথা অখিলেশের মতো পাঠককেও আঘাত করে। এভাবে কি সত্যিই ভেবেছি?
মার্টা আব্বারকে লেখা পিরানদেল্লোর চিঠি প্রসঙ্গে খুব জরুরী একটা লাইন ‘...তিনি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার তাঁর নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারেনি। নোবেল পাওয়ার পর সুইডেন থেকে ফিরে তিনি যখন স্বদেশের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থেকে নামলেন, তখন স্টেশনে পিরানদেল্লোকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য একজনও উপস্থিত ছিল না।’ –এই লাইনটা জরুরী মনে হল কারণ চমকে উঠি এ লাইন পড়লে। নি;সঙ্গতা বিমূর্ত নয়। নিঃসঙ্গতাই চূড়ান্ত বাস্তব কিন্তু কী তার রূপ? শিল্প, সাহিত্য, সৃষ্টি কোনোকিছুই এই নিঃসঙ্গতাকে অতিক্রম করতে পারে না?     
   
পুরো উপন্যাসে প্রেমিকার কোনও নামকরণ নেই। অথচ যে চরিত্রকে ঘিরে উপন্যাসের যাত্রা তার মননের ওঠাপড়া নামহীন থেকেও তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। এমনকি সেই চরিত্রের মনন, ভাঙাগড়া, হারিয়ে যাওয়া ও শেষপর্যন্ত সিঙ্গল মাদার হওয়ার সিদ্ধান্ত অখিলেশের মতোই তাঁকেও ঝুঁকে পড়তে দেয় না শেষপর্যন্ত। এখানেই স্রষ্টার অসামান্য কীর্তি। উপন্যাস জুড়ে বেশিরভাগ সময় এক পরাস্ত মানুষের বিষণ্ণ অবনত মুখ পাঠকমনে উঁকি দিলেও গভীর ছায়া ফেলতে পারে শেষপর্যন্ত সম্ভ্রমে, শ্রদ্ধায় শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকা মানুষটা। উপন্যাসের শেষে পাঠকের মনে তাই এক অনির্বচনীয় ঘোর লেগে থাকে। আর না দেখা চরিত্রদের মুখ যেন ঈশ্বরের মুখ মনে হতে থাকে।     

    

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম