বিনয় মজুমদারকে নিয়ে কিছু লেখা আমার পক্ষে সহজ নয়। বস্তুত এ যেন প্রচণ্ড
গ্রীষ্মে, মধ্যাহ্নে ছাদের উপর বসে, দাবদাহ প্রসঙ্গে উত্তুঙ্গ সারগর্ভ
একটি রচনা লেখার চেষ্টা করা। আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, এমতাবস্থায় একটি মরণশীল স্বেদবিন্দুই হতে পারে না-কি
সবচাইতে সৎ-সৃজন? অবশ্য তাতেও সমস্যা
থেকেই যায়। পাঠকের কাছে কীভাবে সম্ভব হবে ওই
লবনচিহ্নের মর্মোদ্ধার? সাদা কথায় আমি তাঁর
জীবনে একটি কণাও নই, কিন্তু বাস্তবিকই
বিনয় মজুমদার আমার প্রাণের অংশ, আমার কবিতযাপনের
শুরুয়াদ। তাই বিনয় মজুমদার সম্পর্কে লিখতে বসে
সবচেয়ে সৎ লেখাটি তো হওয়া উচিৎ আত্মজৈবনিক। তবু এ-কথা, সে-কথা নয়। শুধু তাঁর মেধার চরণ ছুঁয়ে, স্মৃতিভারাতুর বেদনার নম্র অভিধানখুলে, তাঁরই কবিতা সম্পর্কে এ স্থানে দু’একটি কথা নিবেদন
করি।
যদি মানুষের চেতনার সাপেক্ষে এই মহাবিশ্ব কিঞ্চিত ক্যাওটিক হয়ে থাকে, তবে পৃথিবীর এই প্রান্তিক অবস্থানে (আক্ষরিক অর্থেই।
শুধু আমাদের আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকেই পৃথিবীর দূরত্ব ত্রিশ হাজার আলোকবর্ষ) মানব
যে এতদিন এত প্রতিকূলতা জয় করে এতকাল টিকে থাকতে পারলো তার একটা কারণ, সামাজিক বিশৃঙ্খলাগুলিকে সামাজিক অনুশাসন দিয়ে
সমষ্টির উপযোগী করে তোলা বা তারও আগে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত বিশৃঙ্খলাগুলি
ছেঁটে, খাটো করে, সর্বজন গ্রাহ্য ও
উপযোগী করে, বহুজন সমাজের প্রতিষ্ঠা। এভাবেই গোষ্ঠী, উপজাতি এবং পরিশেষে জাতি, দেশ ইত্যাদির উদ্ভব।
বাস্তবিকই এ এক বৃহৎ বিশৃঙ্খলার ভিতর থেকে তাকে নিয়মনিষ্ঠ করে, সামাজিকভাবে পরিবেশন করা। মানে সোজা কথায়, ব্যক্তির জগাখিচুড়িকে সামাজিক খিচুড়ি হিসেবে পরিবেশন
করা। আর এতে নীতিশিক্ষার একটা বিশেষ ভূমিকা থেকে গেছে। কী ভাবে বা কার কাছ থেকে
শেখে মানুষ? কারণ সত্য তো সত্যই। মানবনিরপেক্ষ।
সত্যের কাছে মানুষের শিক্ষণীয় কিছু নেই। মানুষ তাই মিথ্যা আবিষ্কার করেছে। ব্যবহার
করেছে একটা কৌশল হিসাবে। সাথে সাথে গড়ে উঠেছে কল্প-কাহিনী-পুরাণ-কিম্বদন্তী।
কল্প-কাহিনী-গান-চিত্রকলাকে আঁকড়ে আবার নীতিশিক্ষা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ
করেছে। অর্থাৎ মানুষের জীবনে
সত্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে নীতিশিক্ষার মাধ্যমে। এবং সামাজিক অর্থে সৎ হয়ে ওঠাকে, মানুষ ভেবেছে সত্যদর্শন। সেটা যে নয়, তাও আমরা আবার জেনেছি শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছ থেকেই।
কিন্তু সেই আলোচনা এখানে নয়।
আধুনিক বাংলা কবিতায় বিনয় মজুমদারও সত্যদর্শী শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, সত্যদর্শন করান। মনে রাখতে হবে বিনয় মজুমদার যখন তার
পথটি পরিষ্কার করে দেখতে পাচ্ছেন, বা তার নিজের কথায়
“আবিষ্কার” করে নিয়েছেন, সে এক উত্তাল সময়।
পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি। তাঁর সমসাময়িক বাংলাভাষার আরেক মহত্তম কবি উৎপল বসু
যেখানে নীতিশিক্ষাগুলিকেই চ্যালেঞ্জ করেন বা নিজস্ব কাব্যালোক দিয়ে পরখ করেন, বা প্রশ্ন করেন সমাজস্বীকৃত অনৈতিকতাগুলিকেই, কেন তারা অনৈতিক, বিনয় কিন্তু সেটা না
করে বরং জাগতিক নিয়মনীতি বা শৃঙ্খলাগুলিকে সূত্রের আকারে প্রকাশ করেন তার কবিতায়।
এই ভঙ্গিটিও তার একান্ত নিজস্ব। জীবনানন্দের উপমাগুলি যেমন একবারেই জীবনানন্দীয়, মূলত বর্ণনাত্মক। বিনয় তার দর্শন পরিবেশন করেন
অত্যন্ত অভিনব ভাবে, মূলত উপমার আকারে, পর্যবেক্ষণ ও তৎপরবর্তী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। তিনি
বলেওছিলেন একটি লেখায়, “সৃষ্টির মূল যে
সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও
প্রকাশিত। এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয় একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান।” অর্থাৎ
পর্যবেক্ষণ এবং অনুসিদ্ধান্তের দ্বারা তিনি যেমন দেখাতে চাইলেন সত্যটি এই-ই, রূপকের আশ্রয়ে তেমনি যেন তিনি বলেও দিলেন, মানুষ বা তার জীবনের অনুষঙ্গে এই সত্যটি অবিকল একই।
সূত্রটি অনুরূপ। এমন নয় তাঁর এই দেখাগুলি অভিনব। বরং বিনয় সাধারণ দেখাকেও অসামান্য
ভাবে সংজ্ঞায়িত করেন এই বলে যে এই একই সূত্র অন্যত্র, জীবনেও রয়েছে।
এইভাবে যেন-বা সত্যের পুনরাবিষ্কার করলেন বিনয়। এভাবেই তিনি হয়ে যেন হয়ে উঠলেন শ্লোক-প্রণেতা, আধুনিক ধর্ম-ব্যাখ্যাতা। “ফিরে এসো চাকা”এবং
“অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”-য় তিনি পঙক্তির পর পঙক্তি কবিতার আড়ালে শ্লোক লিখেছেন, টিকা লিখেছেন, লিখেছেন সূত্র।
আক্ষরিক অর্থেই অননুকরণীয় তাঁর এই diction, কবিতায় যার কোন
পূর্বাপর নেই। হয় না।
“বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;”
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;”
“অতি অল্প পুস্তকেই
ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।”
“বর্ণাবলেপনগুলি কাছে
গেলে অর্থহীন, অতি স্থূলমনে হয়
অথচ আলেখ্যশ্রেণি কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।”
অথচ আলেখ্যশ্রেণি কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।”
"পাখিদের থেকে সব
পাখি জন্মে, আলোকের থেকে জন্মে সকল আলোক।
এর বিপরীতভাবে, পাখি যদি মরে যায়
তবু সেই মৃতদেহ পাখি
গাছ যদি মরে তবে যা থাকে তা— তাও গাছ, মৃত বলে অন্য-কিছু নয়।
সেইভাবে আমাদের মন ম’রে গেলে পরে যা
থাকে তা— তাও মন মৃত্যুর নিয়মে।”
২। “বিনয়ের অনেক কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমরা বুঝি তেমন এক
অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি যেন এরপর আর কোন কবিতা হয় না।”-- উৎপল কুমার বসু
উৎপল কুমার বসু
একবার বিনয়ের কবিতা সম্পর্কে ফাইনালিটির কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ যতক্ষণ একটি সত্য বা একটি পর্যবেক্ষণ বিনয়ের কবিতায় লেপ্টে আছে, পাঠক হিসাবে সেখানে
প্রায় আত্মসমর্পণ করে বিনয়ের দেখান পথেই সত্যদর্শন করে নিতে হয়। আমি একে ফাইনালিটি
না বলে তর্ক-নিরপেক্ষ বা Closed discourse বলতে চাই। বিনয়ের
কবিতার পঙক্তির পর পঙক্তি তুলে দেখানো যায়, বিনয়ের কবিতার এই
তর্কনিরপেক্ষতা।
“শিশুদের আহার্যের
মতোন সরল হও তুমি;
সরল, তরল হও; বিকাশের রীতিনীতি এই।”
"সকল ফুলের কাছে এতো
মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।’'
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।’'
"...এই মহাশূন্য শুধু
স্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ মুগ্ধ হতে পারে।"
স্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ মুগ্ধ হতে পারে।"
“...মাটির গভীরে ইতস্তত
সভ্যতার অবশেষ খুঁজে পাই, পেয়েছি অনেক।”
উপরের এই পঙক্তিগুলি
বেছে নেবার কারণ, বিনয়ের কবিতায় পর্বে পর্বে এমন অনেক
লক্ষ্যভেদী মহিমান্বিত তীর রয়েছে, যারা যে কোন
পরিস্থিতিতে লক্ষ্যভেদে সক্ষম বা তর্কাতীত। কিন্তু কিছু এমন পঙক্তিও রয়েছে, যেমন উপরের এই
পঙক্তিগুলি, যেগুলি বিনয়ের কবিতার শরীর থেকে খুলে ফেললে, দেখা যাবে এই
পঙক্তিগুলি একই রকমভাবে তর্ক-নিরপেক্ষ (Closed discourse) নয়।
উক্ত উপমাগুলির
প্রথমটির ক্ষেত্রে, আমরা জানি সরল, তরল হওয়া সবসময়
বিকাশের রীতিনীতি নয়। দ্বিতীয়টি, নির্ভর করছে পাঠকের
রুচি ও খাদ্যাভ্যাসের উপর। একজন নিরামিষাশী মানুষ, পঙক্তিটির আক্ষরিক
অর্থই উদ্ধার করতে পারবে না। তৃতীয়টি মহাকাশ-বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী
তথ্যগত দিক থেকে বিভ্রান্তিকর। চতুর্থটি, উৎপলকুমার বসুর
বর্ণিত ফাইনালিটি বা একটি অন্তিম অবস্থা নির্দেশ করে। “বিনয়ের অনেক কবিতা পড়তে
পড়তে মনে হয়েছে, আমরা বুঝি তেমন এক অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি যেন এরপর আর কোন কবিতা হয়
না।” –এই উক্তিটি কিন্তু কোন (গুণবাচক) প্রশংসাবাক্য নয়, বরং বিনয়ের
কাব্যশৈলীকে ব্যাখ্যা করতেই বোঝান হয়েছে বলে আমার ধারনা।
এই অতুলনীয় শৈলী, যা একান্ত বিনয়েরই, শেষদিন পর্যন্ত
বিনয়ের কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রলক্ষণ।
"রাতের বেলায় সব
বেশি-বেশি করে বাড়ে, বড় হতে থাকে
আলো খুঁজে পেতে গিয়ে, আলো ভালবাসে বলে সবই কীরকম
তাড়াতাড়ি করে বাড়ে, প্রায় সব ফুলই তাই রাতে ফুটে থাকে।"
আলো খুঁজে পেতে গিয়ে, আলো ভালবাসে বলে সবই কীরকম
তাড়াতাড়ি করে বাড়ে, প্রায় সব ফুলই তাই রাতে ফুটে থাকে।"
"রমণ না করে কোনো
রমণী ও পুরুষের বন্ধুত্ব টেকে না,
খুব বেশিদিন ধরে তাদের বন্ধুত্বভাব কখনো টেকে না।"
খুব বেশিদিন ধরে তাদের বন্ধুত্বভাব কখনো টেকে না।"
৩।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ফিরে এসো চাকা এবং
পরবর্তীকালেও বিনয় মজুমদারের অনেক সফল কবিতা শুরু হয়েছে একটি অনুসিদ্ধান্তমূলক
বিবৃতি থেকে।
“মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে।” বা “শিশুকালে শুনেছি কতিপয়
পতঙ্গশিকারী ফুল আছে।”
শুধু এই দুটি প্রথম পঙক্তি এখানে একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক।
“মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে।” অর্থাৎ যেন বলা হচ্ছে, ১। মুকুরের নিজস্ব আলো নেই। ২। প্রতিফলন হয়, তাই সূর্যালোক হাসে। ৩। এই হাসি সূর্যালোক ও মুকুর, উভয়ের যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল ৪। এই হাসির স্থায়িত্ব দীর্ঘ নয়।
“শিশুকালে শুনেছি কতিপয় পতঙ্গশিকারী ফুল আছে।” ১। শিশুকাল থেকে জ্ঞাত এই
জ্ঞান এখনো প্রয়োজনীয়। ২। সব ফুল পতঙ্গশিকারী নয়। ৩। ফুল শুধু কীটপতঙ্গ আকর্ষণ করে
না, কখনো কখনো শিকারও করে। ৪। ফুলের সৌন্দর্য কখনো কখনো
মারণ-ফাঁদ হয়ে দেখা দেয়।
যেন কবিতাটি শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। বস্তুত আমি বিনয় মজুমদারের এই সব
কবিতা পড়তে গিয়ে একটি প্রিজমকে দেখতে পাই। যার শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে আছে ভূমি অর্থাৎ
কবিতাটির প্রথম লাইন। আর প্রিজমটি যেন একটি উল্টানো পিরামিড। ভূমির দিকটি, ত্রিভুজটি হা করে গিলে নিচ্ছে মহাসূর্যের আলো, মেঘের আবডাল ফুড়ে। যেন সকল আলো, বহুবর্ণ আলো, একীভূত হয়ে
প্রিজমটির সরু দিক থেকে নেমে আসছে কবিতাটির শরীরে...যেন প্রিজম নয়, একটি আলোর ফানেল। তো প্রিজমটির এই অদ্ভুত আচরণ মানে
উলটো হয়ে থাকা, যেন ভেসে থাকা, মেঘের মত, কিন্তু তার অসহ
ভার-বিন্দুটির আবার ছুঁয়ে থাকা কবিতার শরীর...এরকম কেন হয়? এই-ই কী কবির Unbearable Lightness of Being!
“The heavier the burden, the closer our lives come to the earth, the
more real and truthful they become. Conversely, the absolute absence of burden
cause man to be lighter than air, to soar into heights, take leave of the earth
and his earthly being and become only half real, his movements as free as they
are insignificant…What then shall we choose? Weight or lightness?” Milan
Kundera: The Unbearable Lightness of Being
৪।
“Knowledge is simply the result of the game, confrontation, junction,
struggle and compromise between instincts. It's because instincts meet, fight
and eventually end up at the end of their battles, to a compromise that
something happens. This something is knowledge ".---- Michel Foucault,
known and written (1954-1988)
আবহমান কবিতা-বিশ্বের একটি শীর্ষবিন্দু নিশ্চই “ফিরে এসো চাকা”-র ২ নং
কবিতাটি। বাংলা কবিতার সবচেয়ে আলোচ্য পঙক্তির একটি হল, এই কবিতার শেষ
লাইনটি। ব্যক্তিগত ভাবে আমিও বিশ্বাস করি, পোস্টমর্টেম হয় শুধু
মৃতের। তবুএই অবিনশ্বর কবিতাটিকেও আমি বহুবার দেখেছি শল্যচিকিৎসকের টেবিলে শুয়ে
থাকতে। আমি শুধু এর শেষ স্ট্যানজাটি আরেকবার পুনঃপাঠ করতে চাই, পাঠককে সামনে রেখে, সাক্ষী রেখে। এবং
ধর্মত এই লাইনগুলি কী বলছে সেই বিষয়ে চূড়ান্ত রায়, পাঠক আপনার। প্রথমে পড়ে দেখা যাক
শেষ স্তবকটি।
“সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!”
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!”
গোটা স্তবকটিতে তিনটি পর্যবেক্ষণ এবং কবি তা থেকে কী অনুসিদ্ধান্তে
পৌঁছেছেন সেই কথা বলা আছে। তিনটিই পর্যবেক্ষণ। প্রথম পর্যবেক্ষণটি রয়েছে মাঝখানে, সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে।
শুশ্রূষা... মমতা, স্নেহ, ভালবাসা... ভালবাসার ব্যাপকতা... ব্যাপ্তি বা
বিস্তার। এই বিস্তার লাভের আকাঙ্ক্ষা যত বাড়ে, ততই বিপদের আশঙ্কা, ততই ভালবাসার স্থানাংকে অবস্থানগত দৌর্বল্য তৈরি হয়।
যত তার ব্যাপ্তি, ততই নিজেকে হারিয়ে
ফেলার ভয়, বা আশঙ্কা রয়েছে বলে কবি মনে করেন। এটা
ততটাই স্বাভাবিক, যতটা স্বাভাবিক
“মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।” অবশ্য এর অন্য পাঠও সম্ভব। যেমন, সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া ভাল লাগে। স্বাভাবিক। ঠিক
সেরকমই স্বাভাবিক, বিপদের আশঙ্কা জেনেও
আমরা আরো জাগতিক বিশালতা, মহাজাগতিক বিস্তারের
দিকে সঞ্চারিত হতে চাই। অথবা এও হতে পারে, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার
দুর্মর বাসনা বা অজানাকে জানবার চিরজাগরুক
স্পৃহাও যেমন একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, অসুস্থ শরীরে ঠিক
তেমনি ভাল, গৃহকোণে মমতার স্পর্শ, শুশ্রূষার হাত। তো এটি এক একজন এক একরকম পাঠ করবেন
তাই-ই স্বাভাবিক। কিন্তু পাঠককে যেটি হতচকিত করে, তা হল শেষ
পঙক্তিটিতে “প্রকৃত” শব্দটির অবিশ্বাস্য ব্যাবহার। আমি এবং অনেকেই ঠিক এই একটি
শব্দে এসে মূর্ছা যাই। আমি এমনও বলতে শুনেছি, ‘প্রকৃত’ শব্দটি আসলে নাকি ছন্দ ঠিক রাখতেই পয়ারের
সমুদ্রে ভেসে এসেছে। কেউ বলেছেন, ‘প্রকৃত সারস’ প্রকৃত
প্রস্তাবে কবিতা, শিল্প, সৌন্দর্য, প্রেম, ভালবাসা...ইত্যাদি। আবার কেউ-বা বলেছেন এটি
বিশ্ব-সংসারের সেই রহস্য, যা মানুষের অগম্য।
এই অমেয়কে স্পর্শ করবার অধিকার, বিধাতা মানুষকে
দেয়নি। আমি এর কোনো সম্ভাবনাকেই অসম্ভব ভাবিনি কখনো।
আবার গ্রহণও করিনি কোন কালেই। কারণ প্রধানত এবং শেষ পর্যন্ত আমি আটকে থাকি
একটি সম্ভাবনায়। এবং এর থেকে কখনো পরিত্রাণ পেতেও চাই না। আর সেটি হল, তবে কী ‘অপ্রকৃত’ সারসও হতে পারে?!!! এই অপ্রকৃত সারস কিন্তু ধর্মের তপোবনে ঘুরে বেড়ান
অধর্মের জিরাফ নয়, বা ধর্মের শৃঙ্খলার
বিপরীতে জিরাফের জেনেটিক ক্যাওস নয়। অথচ বিনয় মজুমদার যে প্রকৃত সারস লিখলেন এর
কিন্তু কোন পূর্বসূত্র নেই, তাও নয়। জীবনানন্দ
লিখেছিলেন “যেতে যেতে মূল সারসের সাথে হল দেখা।” এমন কিন্তু নয়, “মূল” শব্দটি থেকে “প্রকৃত”শব্দটি অনেক দূরের। কিন্তু
বাক্য দুটিতে এদের ব্যাবহার সম্পূর্ণ আলাদা। একটিতে “মূল” সারসের সাথে দেখা হয়, হয়ত তাকে জানা যায়। “মূল” বলতে এখানে প্রধান। তার
“সারস”-ত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রকৃত সারস? তাকে কিছুতেই জানা
যায় না এবং সেই কারণেই সে প্রকৃত। এই তার অ্যাসিড টেস্ট। এ যেন প্রব্যাবলিটির অঙ্ক
কশে দেখান হয়েছে, প্রকৃত সারসের সাথে
মানুষের দেখা হবার সম্ভাবনা শূন্য। কিন্তু যদি অসীমে কোন
একটি অক্ষবিন্দুতে গিয়ে তার সাথে দেখাও হয়, তবে সে আর প্রকৃত
থাকে না! কী বলে ডাকব তাকে? প্রতি-সারস? অপ্রকৃত জগতের প্রকৃত সারস? ফলত এই সঙ্গে সঙ্গে
কবি কী একটি বিকল্প-জগত (Multiverse)-এর কথা বলেন? (ম্যাটার...অ্যান্টিম্যাটার...ডার্ক এনার্জি...?) যেখানে পার্থিব অর্থে অপ্রকৃত সারসের সাথে কবির দেখা
হয় কোন এক হেমন্তের বিকেলে, কথা হয়, “এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।”
*************************************************************************************
কথোপকথন- ১
বিনয় মজুমদার আমাকে একবার কথা প্রসঙ্গে, প্রায় স্বগতোক্তির
ভঙ্গিতে, আশেপাশে কেউ নেই— দেখে নিয়ে বলেছিলেন, “ভেবে দ্যাখ, তুমি কোন গোপন
জ্ঞানের অধিকারী কি-না। এমন কোন জ্ঞান, এমন কোন কিছু, যা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তারপরেই বললেন, “এরকম কোন গুপ্ত-জ্ঞান তোমার থাকলে, তবেই লেখ। সেই লেখা লোকের কাজে আসবে।” বোঝাই যাচ্ছে
কবিতা যাতে লোকের কাজে আসে, মানুষ, কবির কাছে শিক্ষণীয়কিছু আশা করে, এই রকমই একটি উচ্চ ধারণা কবিতা সম্পর্কে পোষণ করেছেন
বিনয় মজুমদার, আজীবন।
কথোপকথন- ২
“বিনয়দা, কবিতা আর পদ্যের
মধ্যে পার্থক্য কী বলে আপনার মনে হয়?” বিনয়দা কিছুক্ষণ পরে, ডান হাতের তর্জনী উঁচু করে, অমৃতলোক নির্দেশ করে
কী এক গূঢ় স্বরে বলেন, “একটি পাখির গান
কী-রকম ভাল!” ‘কী’-র দীর্ঘ ঈ-কারটি যারপরনাই দীর্ঘ এবং সঙ্গে অন্তত ৩ টি
বিস্ময়সূচক চিহ্ন (!) ও একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন (?) ইনফিউসড ভাবে
উচ্চারিত হয়। তারপর বিনয়দা অস্ফুট স্বরে বলেন, “এই হল কবিতা”। বলাই
বাহুল্য আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই পাখির অনুচ্চ গানটিকে, দেখতে পাই তার অলৌকিক মেধাবী-সারল্য। কিন্তু আমার
নির্বুদ্ধিতা আমাকে বলে, পদ্যকেও একঝলক
চাক্ষুষ দেখে নাও! আমি, গাছের বিশেষত নিচু
শাখাগুলিতে তাকে খুঁজি। বিনয়দা চুপ করে থাকেন, কোন কথা বলেন না।
আমিও কবিতা বা পদ্য, কাউকে দেখি না আর
আশেপাশে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মণিশংকর বিশ্বাস
Khub valo
ReplyDeleteবিনয় মজুমদারের ওপর এত ভালো লেখা খুব কমই পড়েছি।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো লেখাটি
ReplyDeleteঅসামান্য লেখা মণিদা। একবার পড়ে আশ মেটে না। বারবার পড়ে অনুধাবন করার মতো লেখা। এই লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শুভকামনা জানাই।
ReplyDelete