বিদ্যসাগরের মূর্তি দ্বিতীয়বার ভাঙ্গা পড়লো। প্রথমবার
ঘটেছিলো খূব সম্ভবত ১৯৭০-এ, নক্সালবাড়ি আন্দোলনের উত্তুঙ্গ অবস্থায়। যে
নক্সালপন্থী যুবকেরা মূর্তি ভেঙ্গেছিলো তাদের একটি যুক্তিক্রম ছিলো। প্রথম
যুক্তি ছিলো বর্তমান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপরে আঘাত হানতে হবে সম্পূর্ণ নতুন
শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করার। এবং পুরনো
রাষ্ট্রের প্রতীক-চিহ্ন হিসেবে যে মূর্তিগুলো রয়েছে সেগুলোকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে।
সেদিন ছাত্রসমাজের মাঝে এই কর্মসূচী অসম্ভব উন্মাদনা তৈরি করলেও ভ্রান্ত যুক্তির
ওপরে এ ধরনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার দরুণ পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর জনসমাজ একে
প্রত্যাখ্যান করেছে। সরোজ দত্ত যিনি শশাঙ্ক ছদ্মনামে দেশব্রতী-র পাতায় মূর্তি
ভাঙ্গার সপক্ষে ধারাবাহিকভাবে লিখতেন এবং যাঁর মৃত্যু হয়েছিলো রাষ্ট্রের হাতে,
ময়দানে, গলা কাটা অবস্থায়। তাদের যুক্তি ছিলো বিদ্যাসাগর ইংরেজদের দেওয়া CIE (Companion of Indian Emperor)
খেতাব পেয়েছিলেন এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় সংস্কৃত কলেজকে গোরা
সেনাদের থাকার জায়গা করে দিয়েছিলেন। এজন্য বিদ্যাসাগরের মূর্তির জায়গায় সিপাহী
বিদ্রোহের বা ভারতের “প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের” সূচনা যার হাতে হয়েছিলো সেই
মঙ্গল পাণ্ডের মূর্তি বসানো হবে। তাঁর প্রথম যুক্তিটি ঐতিহাসিক সত্য। এরকম খেতাব
একা বিদ্যাসাগর নন আরো অনেকেই পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর খেতাব ফেরত দেননি। আমার
বিচারে, দেবার মতো কোন পরিস্থিতি উদ্ভুত হয়নি। দ্বিতীয় যুক্তিটি ভ্রান্ত – আবেগের
বহিঃপ্রকাশ। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় আতঙ্কিত ইংরেজ সরকার কলকাতা শহরের বিভিন্ন
বড়ো সরকারি অট্টালিকা সৈন্যদের মজুত করার জন্য দখল করেছিলো। এর মধ্যে সংস্কৃত কলেজ
ছাড়াও হিন্দু কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসার বৃহৎ অট্টালিকাও ছিলো। ঘটনা পরম্পরায় মনে
হয় সরকারের এ সিদ্ধান্ত বিদ্যাসাগর খুব সহজে মেনে নেননি। বিদ্যাসাগরের ১১ আগস্ট,
১৮৫৭-তে লেখা চিঠির উত্তরে গভর্নমেন্টের সেক্রেটারি গর্ডন ইয়ং ১৭ আগস্ট, ১৮৫৭-তে
তাঁকে লেখেন – “আপনার ১১ তারিখের চিঠির উত্তরে আমি ভারত সরকারের সামরিক বিভাগের
সেক্রেটারির চিঠির একটি কপি আপনাকে পাঠাচ্ছি। সেই চিঠিতে আপনি দেখতে পাবেন, হিন্দু
ও মাদ্রাসা কলেজের অট্টালিকা দুটি সৈন্যদের বাসের জন্য গভর্নমেন্ট সাময়িকভাবে দখল
করবেন মনস্থ করেছেন। আপনাকে তাই অনুরোধ করছি যে আপনি আর বিলম্ব না ক’রে এখনই
গ্যারিসন-কমান্ডারের হাতে আপনার বিদ্যালয় গৃহ ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করবেন।” পরের
দিন অর্থাৎ ১৮ আগস্ট, ১৮৫৭, গর্ডন ইয়ং আবার চিঠি লেখেন – “সৈন্যরা আপনার
বিদ্যালয়গৃহ দখল করলে আপনি আপনার ছাত্রদের শিক্ষা সমস্যার এবং ক্লাসের সমস্যার
সমাধান কিভাবে করবেন, সে সম্বন্ধে চিন্তা ক’রে যতশীঘ্র সম্ভব পত্রোত্তরে আমাদের
জানাবেন।” এরপরে মাসিক ১০৫ টাকা ভাড়ায় দুটি বাড়ি ভাড়া করে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত
কলেজের কাজ চালাবার ব্যবস্থা করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭-তে ভারত সরকার এই ব্যয়
মঞ্জুর করেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে সংস্কৃত কলেজে আহত সৈনিকদের শুশ্রুষার জন্য
হাসপাতাল খোলা হয়েছিলো। (বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃঃ ১৮৬) অবশ্য
সংস্কৃত কলেজে তৎকালীন হিন্দু সমাজের ছাত্রদের আধুনিক মেডিসিনের শিক্ষায় শিক্ষিত ও
দীক্ষিত করে তোলার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি হাসপাতাল খোলা হয়েছিলো। সে অবশ্য
অন্য কথা।
আমি বিদ্যাসাগর বিশেষজ্ঞ নই।
সেজন্য নীচে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ করা আছে। এ সত্ত্বেও বিদ্যাসগর নিয়ে দুটি কথা বলা
নিতান্ত প্রয়োজন – (১) তাঁর ধর্ম-নির্লিপ্ততা। তাঁর “সর্বদর্শনসংগ্রহ” গ্রন্থে
নিরীশ্বরবাদী চার্বাকদের নথিবদ্ধ করা ছাড়াও সেসময়ের প্রাধান্যকারী “মায়া” ও
ঈশ্বর-লগ্ন বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনকে “false systems of philosophy” বলতে দ্বিধা করেননি। সেই সময়টা মাথায় রাখতে হবে। তাঁর করা অনুবাদের ১৮৫১
সালে প্রথম প্রকাশিত Chamber’s Educational Course-এর বাংলায়
অনুবাদের ১৮৫৭ সালে পঞ্চম মুদ্রণ হচ্ছে। ইংরেজি
বইটি বাংলায় অনুদিত হচ্ছে “জীবনচরিত” নামে। কারা রয়েছেন জীবন চরিতের তালিকায়? কোপার্নিকাস,
গ্যালিলিও, নিউটন, হর্শেল, লিনিয়াসের মতো বিজ্ঞানের মহাবৃক্ষরা। কোন ধর্মগুরুর কথা
নেই। খেয়াল রাখবো সালটা ১৮৫১-৫৭। (২) জেনারেল হার্ডিঞ্জকে অনুরোধ করে ১০১টি
বঙ্গবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যখন তিনি মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান ও নদীয়ার
অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর ছিলেন তখন ছোটলাট হ্যালিডে সাহেবের “বাচনিক আদেশে শতাধিক
বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন”। (চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃঃ ৩৫২)
এখানে বিদ্যাসাগরের নিজস্বতা, একান্ত সত্তা, individuality। সম্পূর্ণ
বাংলা ও বাঙ্গালীর মাঝে প্রোথিত তিনি। ব্রায়ান হ্যাচার মন্তব্য করছেন – ‘native’ should be understood to
mean what is local, changing, and open to redefinition.” (Idioms of
Improvement, p. 265) এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় বিদ্যাসাগর।
একবার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বুট না পড়ে “তালতলার চটি” পড়ে গেলে প্রবেশাধিকার বঞ্চিত হন।
তিনি ফিরে এসে মুখে মুখে এই অসামান্য শ্লোকটি রচনা করেছিলেন –
বিদ্বতঞ্চ
জুততঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে
পূজ্যতে বিদ্যা, জুতা সর্বত্র পূজ্যতে।।
অবশেষে ইংরেজরা বিদ্যাসাগরী চটিকে
ছাড়পত্র দেয় বিদ্যাসাগরের “ইন্ডিভিজুয়ালিটি” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে। মচকানোর মানুষ
তো তিনি ছিলেননা। (বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃঃ ৩৫৫)
কিন্তু এবারে বিদ্যাসাগরের
প্লাস্টার অব প্যারিসের মূর্তি ভেঙ্গেছে (মচকায়নি, অবশ্য বিদ্যাসাগর মচকানোর মতো
লোক ছিলেননা) সম্পূর্ণ অন্য কারণে। এক নির্মিত নৈরাজ্য এবং অন্ধকার জগতের থেকে উঠে
আসা পেশি শক্তির হিংস্র প্রকাশের ফলশ্রুতিতে। এর মাঝে ১৯৭০-এর মূর্তি ভাঙ্গার কোন
সাযুজ্য কোন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ নিশ্চয়ই খুঁজতে যাবেননা!
(বিধিসম্মত সতর্কীকরণ
– শুরুতেই বলা ভালো এরকম সতর্কীকরণ অনেকটা ধূমপান নিয়ে বিধিসম্মত
সতর্কীকরণের মতো। গয়লানী উপযুক্ত পরিমাণ দুগ্ধ সরবরাহ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়,
পাড়ার মোড়ে অহিফেনের গুলির যে দুটি দোকান ছিলো সে দুটোও সরকারি নিয়মকানুনের
প্যাঁচে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে। আমার আবার “পাতা” বা “তামাক” চলেনা, গুরুদেব বারণ
করেছেন। ফলে জৈষ্ঠ্যের এই ভরা গরমে কিছু অসংলগ্নতা ঢুকে পড়েছে কথার মাঝে, বলার
মাঝে। কি আর করি! দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের চরিত্রদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসা “brain fever”-এ
আক্রান্ত হবার মতো দশা। দস্তয়েভস্কির চরিত্রেরা অনেক কিছু মনে করতে
পারেনা, ফলে বেনিফিট অব ডাউট পেয়ে যায়, স্মৃতিহরণ ঘটে।
আমারও কি তেমন কিছু হল? ভয়ে ভয়ে
আছি। প্রয়োজনে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে দেবেন আর কি!)
Engrafted
মডার্নিটির যে যাত্রা
১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে
রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু
হয়েছিল সেখানে সবাই
মানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষ্যণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্রিটিশ জাত প্রায় ৩৫০
বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে ভারত সেসমস্ত ধাপ অতিক্রম করার জন্য
পেয়েছে কয়েক দশক মাত্র। ফলে ইংল্যান্ড সহ
ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে
রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজ জীবনে
ধর্ম-নির্লিপ্ততার (secularism) যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা
ভারতে হয়নি। যেভাবে শ্রমিক তথা মার্ক্সের ধারণানুযায়ী সর্বাহারা শ্রেণীর এবং
পুঁজির সাথে শ্রমের টানাপোড়েন থেকেছে বিভিন্ন স্তরে, যেভাবে দেশগত ভিন্নতা থাকা
সত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও শ্রেণী সম্পর্কের মানুষের একটি পাব্লিক ডিসকোর্সের পরিসর
তৈরি হয়েছে, যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে সমাজ জীবন থেকে অপসৃত
হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে সেসব
তো এখানে হয়নি। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগোলিক ভুখন্ডে সামন্ত
রাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতি শ্রেণী, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি
ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন
স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন
করেছে ১৯৪৭ পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষ। এধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী
ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হলো সেগুলো
মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতা চিহ্ন। এরকম এক ঐতিহাসিকতায় প্রধানত কৃষিসম্পর্কে
আবদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রে মডার্নিটি বা
আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে engrafted হয়ে যায়, ঐতিহাসিকভাবে
সামাজিক পরিবর্তন ও গতিশীলতার (social and historical dynamics) নিয়মে জন্ম নেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার
যে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষে তা প্রায়-সম্পূর্ণ ব্রিটিশ
রাজনৈতিক সংবিধানের ধারায় তৈরি হওয়া। বিশেষ করে আমরা যদি দুটি বিষয় একবার স্মরণ
করে নিতে পারি – (১) ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ স্বয়ং গান্ধী
তাঁর নিজের জীবনের ক্ষেত্রে একাধিকবার দুটি passion-এর কথা
বলেছেন। প্রথমটি হল ব্রিটিশ সংবিধান (Pax Britannica-ও বটে)
এবং দ্বিতীয়টি নার্সিং বা শুশ্রুষা। (২) প্রধানত শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে সমাজ
এবং কৌমের ধারণা খসে গেছে প্রায় ৩০০ বছর জুড়ে। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মাঝে সরাসরি
সম্পর্ক – অধিকার এবং কর্তব্যের বাঁধনে, cash nexus-এর প্রবল
উপস্থিতিতে। এখানে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, যা আছে তা নাগরিক পরিসর
বা সিভিল স্পেস। ডেমোক্রাসির স্বর্ণযুগে কিংবা সামাজিক পরিসরের সবল, জোরালো
উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ,
আত্মপ্রকাশ করে – indiscernible থেকে discernible হয়ে ওঠে, invisibility থেকে visibility-র স্তরে উঠে আসে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র
বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলনের কথা কিংবা সাম্প্রতিক কালের “অন্য
এক পৃথিবী সম্ভব” বা “Occupy Wall Street” আন্দোলনের কথা স্মরণ
করা যেতে পারে। এরকম একটা পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার কিংবা অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিকভাবে মান্যতা,
গ্রাহ্যতা পায়। বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে।
কিন্তু সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক
প্রক্রিয়াটাই যদি ভিন্নধর্মী হয়? যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্ত
রাজা ও এর উপযোগী পরিব্যাপ্ত মানসিকতা, কৃষি শ্রম, শিল্পীয় শ্রম, শিক্ষিত জায়মান
নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পর্বে গড়ে ওঠা ছোট বা স্বাধীন
পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে
জাতিস্বত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে? Integer বা পূর্ণসংখ্যা
না হয়ে, কোন ত্রৈরাশিক বা ভগ্নাংশ কিংবা অ-নাগরিক
হয়ে কেউ থাকতে পারেনা।
আধুনিকতার একটি এবং
একমাত্র ভাষ্যেই এদের
শিক্ষিত করে তুলতে
হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি সবসময়েই
কেন্দ্রাভিমুখী। প্রান্ত এখানে প্রান্তিক, কখনো ব্রাত্যও বটে। অসংখ্য দ্বন্ব
অমীমাংসিত রেখে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য চলমান চরিত্র
(দলিলও বলা যেতে পারে) সতীনাথ ভাদুড়ীর সৃষ্টি
ঢোঁড়াই। এরকম
দলেই পড়বে আমার মতো সুশীল, সুবোধ, গোপাল-বালক গোছের মানুষজন।
যাহোক, ঢোঁড়াই বড়ো মুশকিলে পড়ছিলো ওর
জীবনটাকে নিয়ে। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই ধীরে ধীরে বুঝেছে, আত্মস্থ করেছে
অজানা সব অভিজ্ঞতা – “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জৎ বাড়ে, এর
অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে হয়ে গিয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জৎ বাড়িয়ে
দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” ঢোঁড়াইয়ের ইজ্জৎ সারা গাঁয়ের ইজ্জৎ
হয়ে যায়। “বোটের” সুতোয় রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনো নাগরিক হয়ে
উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার
এক আখ্যান রয়ে যাচ্ছে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে চলা নতুন ভারতবর্ষের
মধ্যে। “বলান্টিয়ারদের” দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর কর্তব্যটুকু
করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” তার মননে বা psyche-তে যোগসূত্র তৈরি হল ঢোঁড়াই আর
“মহাৎমাজীর” সাথে – imagined communities। আধুনিকতার নতুন কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক
ডিসকোর্সে ঢুকে পড়ছে ঢোঁড়াইয়ের মতো প্রান্তিক
মানুষ ও অঞ্চল – নিজস্ব সমাজ ও কৌম বোধ নিয়ে। এটা ব্রিটিশের জগতে জন্ম নেওয়া
ইউরোপীয় আধুনিকতার চেহারা নয়, এর অবস্থান আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে।
ঢোঁড়াইয়ের অন্য এক যাত্রা শুরু হয়। “এই নিঃসীম রিক্ত জগৎটার মধ্যে ‘পাক্কী’ না কী
নামের যেন একটা অপরিচিত রাস্তা দিয়ে সে চলছে।” আধুনিক ভারতের “পাক্কী” রাস্তার
বাঁকে ঢোঁড়াই – ভারতের উন্নয়নের কুল চিহ্ন (insignia)। কিন্তু তার নাগরিকতার মধ্যে
রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান, যদিও রাষ্ট্র তাকে গ্রহণ করবে একক integer হিসেবেই।
রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেলো অন্তর্লীন বিরোধ। ইটি আব্রাহাম অল্প কথায় সমস্যাটাকে
এভাবে বুঝেছেন – “Within these new spaces, a logic different from the
representation of India as ‘traditional’ was meant to operate. These new spaces
would be rationalized, scientifically ordered spaces filled with individuals
who, having shed personal religious or sectarian loyalties would identify
primarily as a modern man – in a word, ‘Indian’.” (The Making of the Indian
Atomic Bomb, p. 21) নিজের সত্তা, অস্তিত্বকে অস্বীকার
করে, ভগ্নাংশকে অন্তর্লীন রেখে ঢোঁড়াইয়ের মতো অগণন মানুষের আধুনিক
রাষ্ট্রের উপযোগী integer হয়ে ওঠার সংকট প্রসারিত হতে থাকবে সামাজিক
বিভিন্ন স্তরে।
ইউরোপীয়
আধুনিকতার ভাষ্য,
যা আমাদের দেশে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে অনুসৃত হচ্ছিল, তার উপাদানের মাঝে (matrix) নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে
আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের
মতো নাগরিকদের ধরা
হবে একেকটি integer বা পূর্ণ সংখ্যা হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশের
কোন জায়গা নেই। উদো-বুধোর ত্রৈরাশিক
না ভগ্নাংশ, এসব
ভাবার কোন অবকাশই
নেই। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আবার আলাদা কিছু হয় নাকি? এগুলো তো
ভগ্নাংশ। পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়।
এরকম
এক social psyche তৈরির অন্যতম
প্রধান হাতিয়ার হল
ভাষা এবং disciplinary time তথা শৃঙ্খলাবদ্ধ সময়। আবার
পূর্ণ সংখ্যা পজিটিভ বা ইতিবাচক হতে পারে, যেমন স্থিতধী, প্রজ্ঞাবতী-প্রজ্ঞাবান সব
নাগরিক। পূর্ণ সংখ্যা নেগেটিভও (নেতিবাচক) হতে পারে। ভাবুন দেখি নেগেটিভ পূর্ণ সংখ্যার
কি ভারী একখানা দল। শুরু করি যদি গোরখপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ কাফিল খানের কথা দিয়ে
– সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ না থাকার ফলে কতগুলো বাচ্চা স্রেফ মরে গেলো,
নিজের গাঁটের পয়সা দিয়ে গাড়ির তেল পুড়িয়ে বাইরে থেকে অক্সিজেন জোগাড় করে ডাক্তারবাবু
বাঁচালেন অনেকগুলো প্রাণ, তারপরে ৮ মাস জেল খাটলেন যেন ওঁর জন্যই অক্সিজেন
সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়নি এমনটা আর কি। আমাদের স্মৃতিতে আসছে কি একটু একটু এ
ইতিহাস? এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে numbing of collective
consciousness – বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা, যাকে বলে historical
and social amnesia – ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। এই বিস্মরণের জোরেই
কিনা ডঃ খানের ভাই যে “অজ্ঞাত পরিচয়” দুষ্কৃতির হাতে মারা গেলো সে কথা বোধ করি আমরা বেমালুম ভুলে
গেছি। পূর্ণ সংখ্যা মানে পজিটিভ পূর্ণসংখ্যা – একখানা গোটা, আস্ত নাগরিক। কিন্তু নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা
কেমন অদ্ভুতভাবে পৃথিবী থেকে, মনুষ্য সমাজ থেকে একে একে খসে পড়তে থাকে – কখনো গৌরি
লঙ্কেশ নামে, কখনো কালবুর্গী, কখনো আখলাক, কখনো আসিফা, কখনো পানেসার। কি লম্বা
মিছিল দেখুন। আমিও দেখি। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কি? কি আর হবে! আমাদের যাপিত সময়ের
জাগ্রত বিবেক শঙ্খ ঘোষ স্মরণ করিয়ে দেন – “আর সব উন্নয়ন পরিত্রাণ ঘূর্ণমান অগণ্য
বিপণি দেশ জুড়ে / যা দেয় তা নেবার যোগ্য নয় / আমাদের চেতনাই ক্রমে অস্পষ্ট করে
সাহায্যের হাত ….. লোকে
ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।” স্মরণ করিয়ে দেন – “বেঁধেছ বেশ করেছ / কী এমন মস্ত ক্ষতি / গারদে বয়েস গেল / তাছাড়া গতরখানাও / বাবুদের কব্জা হলো / হলো তো বেশ, তাতে কি / বাবুদের লজ্জা হলো?” হলো কি
সত্যিই? এসবের মাঝে নিঃসারে গণ পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে, তার রাজনৈতিক চরিত্রের
masculinization তথা পৌরুষীকরণ ঘটেছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলোকে অল্প
অল্প করে দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে (ethical
tranquilization)।
কি বিচিত্র বিষয় ভেবে দেখি একবার! নাগরিক-অনাগরিক,
ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দী-অহিন্দী, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, আলোর
ভারত-আলো-আঁধারির ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির
ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড ডে
মিলের ভারত! উফ, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এত্তো এত্তো ভারতকে মনে রাখতে হবে? সবাইকে
প্রকাশ করতে হবে “তোমারই প্রকাশ হোক”-এর মতো পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? আমার
পরিচালক রাষ্ট্র তো সে কথাই বলছে। আমাদের কি আর নেগেটিভ সংখ্যা হবার – এরকম দলভারী
মিছিল দেখার পরেও – কোন “সদিচ্ছা” আছে বা থাকতে পারে। “আমরা তো অল্পে খুশি / কি
হবে দুঃখ করে / আমাদের দিন চলে যায় / সাধারণ ভাত কাপড়ে!”
হয় তুমি ভারতীয়, নয় তুমি ভারতীয় নও। মানে তুমি আধুনিক, থুড়ি,
বর্তমান রাষ্ট্রের নিয়ম-টিয়ম মানো তো? আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রথম যুগে মানে
ইউরোপে যখন এলায়িত সামন্ত রাজ্য/রাষ্ট্রগুলো নতুন করে জুড়ে এবং বিন্যস্ত হয়ে ধীরে
ধীরে আধুনিক শিল্পনির্ভর জাতীয় রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সেসময় থেকেই তো অস্তিত্বের অন্যসব
স্তর তলিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নাগরিক সত্তার মাঝে। একটি
নির্দিষ্ট ভুখণ্ড নিয়ে, তার নিজস্ব আইনকানুন নিয়ে একটি রাষ্ট্র – বহুলাংশেই জনমতের
উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (যাকে এখন অ্যাকাডেমিক জগতের ভাষায় বলে “manufacturing consent”)। আরো একধাপ এগিয়ে আবার আমার আপনার মতো
কোন অর্বাচীন, অকালপক্ক, অর্ধশিক্ষিত দেখে এর মাঝে hegemony তথা
মান্যতা নিয়ে টিঁকে থাকবার নানা রকমের কৃৎ-কৌশল রয়েছে। কৃৎ-কৌশল রয়েছে রাষ্ট্রের
অতিরাষ্ট্রের হয়ে ওঠার চারিত্র্যলক্ষণের মধ্যে আছে ক্রমশ ঘৃণাকে
সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া – শব্দে, চিত্রকল্পে, প্রাত্যহিক সংলাপে। হিংসাকে
আকর্ষণীয় প্রদর্শনী করে তুলতে হবে (spectacularized violence)। ধীরে
ধীরে এগুলোকে সহনীয় করে তোলা। নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়েও যায়। যাকে পছন্দ করিনা তাকে
‘দানব’ বানিয়ে দাও (demonization), শিক্ষা থেকে থেকে সরিয়ে
দাও প্রশ্ন করার সাহস, উৎসাহ এবং পরিসর। শিক্ষকেরা হয়ে যাক educational
managers, ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোন জ্ঞানভিক্ষু
নয়। একটি সংস্কৃতির জন্ম হবে যার ভিত্তি হবে কেবল তাৎক্ষণিকতা-নির্ভর, শুধুমাত্র
বর্তমানকে চিনি বুঝি যাপন করি, অন্য কিছু নয়। অতীতের এবং ইতিহাসের পুনর্নিমাণ হবে।
সমাজের অন্ধকার জগৎ, যাদেরকে চালু ভাষায় লুম্পেন বলা হয়) আলোয় আসার, রাজপথের দখল
নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে।
এরকম এক পরিস্থিতি অন্য প্রেক্ষিতে
ফ্রানজ ফ্যানঁ (Frantz Fanon) দেখেছিলেন তাঁর The Wretched of the Earth পুস্তকে। তিনি দেখেছিলেন – “The
very same people who had it constantly drummed into them that the only language
they understood was that of force, now decide to express themselves with force.” এরকম এক সময়ে ফ্যাতাড়ুরা আর অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারেনা। এরা
নিজেরাই রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া অন্তর্ঘাতের অংশীদার হয়ে যায়। এর হিংসা আর শক্তি
প্রদর্শনের extra-judiciary,
extra-state হাতিয়ার হয়। এরা “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”-র সৌম্যকান্তি
পাগল চরিত্রটির মতো দুর্বোধ্য “গ্যাৎচরেৎশালা” উচ্চারণ করেনা। এরা স্পষ্ট ভাষায়
হিংসা-ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেয় “অপরের” শরীরে।
পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যেতে থাকে। আমাদের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছেনা।
ঘটনাচক্রে এখানে আক্রান্ত হয়েছেন বেচারা বিদ্যাসাগর। তিনি এই চলমান ঘূর্ণাবর্তের
মধ্যে পড়ে গেছেন।
রাজনৈতিক লুম্পেনিকরণ
বহুদিন ধরেই চলছে। আমাদের বিবেক, মনন, চেতনা বিদ্ধ হলেও, রক্তাক্ত হলেও আমরা মেনে নিয়েছি
বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের আচরণ করছে তাই নয়।
সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া
হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীর প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তাকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে
বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
এখানে সেসবের বালাই নেই। পার্টি
এবং এদের লালিত extra-judiciary and
-democratic institutions লুম্পেনরাজ ঘোষিতভাবে সমাজের
চলন, নীতি, নৈতিকতা, ব্যক্তি জীবনের
প্রতিটি পরিসর - সবকিছু নির্ধারণ করবে।
অঁরি জিরো (Giroux) তাঁর একটি লেখায় আবেগঘন আবেদন
রেখেছেন – “The current
fight against a nascent fascism across the globe is not only a struggle over
economic structures or the commanding heights of corporate power. It is also a
struggle over visions, ideas, consciousness, and the power to shift the culture
itself.”
আমাদের ভারতে তৃতীয় পরিসর এবং নাগরিক পরিসর আরও
সঙ্কুচিত হবে, হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা “চোখে আঙ্গুল দাদা!”
বেচারা ধর্ম-নির্লিপ্ত, নিবিড়ভাবে মানুষকে নিয়ে, বিশেষ করে অন্ত্যজ অন্নহীন
মানুষদের নিয়ে, বেঁচে থাকা বিদ্যাসাগর। তুমি এখানে কে? তোমাকে তো অধুনা ভারতের
রাষ্ট্রশক্তির এবং রাজনীতির কোন প্রয়োজন নেই। তোমাকে ব্যবহার করা যায়না। যেমনটা
যায়না বহুক্ষেত্রেই অমিত প্রতিভার ধারক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথকে কোথাও কোথাও
সিলেবাস থেকে বাদ দেবার প্রস্তাবও এসেছে। কর্পোরেট পুঁজির জন্য তোমরা বর্জনীয়।
এখনো পূর্ণ বিস্মৃতিতে ফেলে দেওয়া যায়নি। এ এক আপদ বিশেষ!
ইতিহাসের তো পুনর্লিখন চলছে।
অনেক নতুন বীর আর শহীদ গড়ে উঠবে। তোমার সামনে নেচে-কুঁদে বেড়াবে। বাঙ্গালী, বাংলা
তথা ভারত বর্তমানের প্রয়োজনেই তোমাকে ভুলে যাবে। নতুন ইতিহাস গড়ে উঠছে!
১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক
করেছিলেন – “কুৎসিত বেশে সজ্জিত বর্বরতাপূর্ণ এই বৈষয়িকতা মানবিকতার বিরুদ্ধে এক
প্রবল অভিশাপ, কারণ পূর্ণতার শক্তির উপরে ক্ষমতার প্রমত্ত আদর্শ চেপে বসেছে। … শক্তিমানের কাছে এই প্রলোভন যতটা
সর্বনেশে, দুররবলের কাছে তা আরও বেশি ভয়ঙ্কর। … আমাদের জীবন
হয়ে উঠুক আর অন্তরঙ্গে মহীয়ান। আর্থিক শোষণ ও বিরোধের উপরে নয়, সামাজিক সহযোগের
ভূমিতে আমাদের সভ্যতা দৃঢ়ভিত্তি লাভ করুক।” (ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ)
আমরা শুনছি কি? বরঞ্চ আমরা
উদ্বাহু হই।
No comments:
Post a Comment