Friday, May 31, 2019

হাঁটি হাঁটি পা পা- বেবী সাউ







অথচ বেরোনো হয় না কিছুতেই। আর এখানেই চোখের সঙ্গে পায়ের বিরোধ বাধে। চোখ বলে যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যাই। পা বলে, উঁহু! সেটি হচ্ছে না। আমার ইচ্ছেটাই সব। পা আর চোখের বিরোধিতার ফল ভোগ করি বেচারা আমি। ইচ্ছে থাকলেও হুটহাট বেরানো আর হয় না! আবার যখন হুটহাটের সময় আগতপ্রায়, প্রায় এক ঘন্টার মধ্যেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকবে তখনই চোখ বসল বেঁকে!  যাবে না? না, বড্ড জেদ তার। কিছুতেই ঘরের কোণ ছেড়ে, মানি প্ল্যান্টের গাছ ছেড়ে এমনকি নেটের প্রিপারেশন ছেড়ে ( এটা তার সবচেয়ে অপ্রিয়। নেটের বই খুললেই এযাবৎ তার চোখ জুড়িয়ে আসত!)...এমনকি রোদ এসে পড়লে যে আলপনা তৈরি হয় মেঝের মার্বেল স্লাইসে, সেটাও মনে পড়ে তার! যেতে চায় না কিছুতেই। কিন্তু তখন উপায় নেই। কী আর করা! অসংখ্য বকুনি হজম করে বেরোই। বেরোতে হয় বলেই বেরোই। গ্যারেজে গিয়ে তখন মনে পড়ে, জুতো জোড়ার কথা, মনে পড়ে সানস্ক্রিন লোশনের কথা। রাস্তায় যেতে যেতে মনে পড়ে জানলা না লাগানোর কথা। আর যখনই স্টেশনে ঢুকছি, মনেপড়ে, মনে পড়েই... আকাশবাণীতে অ্যাপ্লিকেশন জমা দেওয়ার কথা। যাক! এবারটা তো ঘুরে আসি, নেক্সট বার নিশ্চয়ই এসব ভুল আর হবে না... নিশ্চয়ই হবে না? 

প্লেনে কোথাও যাওয়া মানে প্রথম পনেরো মিনিট খুব ভালো,  তারপর দশ মিনিট ধূস! ভাল্লাগেনা! তারপরের ঘুম আর ঘুম। শুধু সাদা সাদা মেঘ দেখে কাহাতক থাকা যায়! তারচেয়ে অটোরিক্সা ভালো। চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। যেন আমার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবীটাও ভ্রমণে বেরিয়েছে! ট্রেনের জার্নিও খুব মধুর। হরেকরকম অ্যাডভেঞ্চার। পরতে পরতে রহস্য।  এই রুমাল বিক্রির দরদাম, এই শোনপাপড়ির দোকানদার।  কিংবা একটা ছোট বাচ্চা অনর্গল বকে যাচ্ছে, এটা ওটা জানতে চাইছে-- আর তার মা চুপচাপ বসে, চেয়ে আছে বাইরের দিকে। যেন ছেড়ে আসা সেই মনখারাপের দিকে,  দেখে নিচ্ছে কোথাও কী একটু খাদ থেকে গেল! কোথাও কী আর একটু অপেক্ষা ছিল! নিজের মুখোমুখি। আর হয়ত উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে জলের বোতল এসে পড়ে! গরম গরম সিঙাড়া এসে পড়ে। আর সেই ছোট শিশু তার আধো আধো বুলি নিয়ে ভাব জমাতে এসেছে কাছে। "হোয়াট ইজ দিস?" "হোয়াট ইজ দিস!" ''ওহ! মাই গড''...করতে করতে পার হয়ে যাচ্ছে একেকটি অপরিচিত  স্টেশন। পার হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি,  রাস্তাঘাট, গাছপালা --- দেখতে দেখতে আমার কেমন একটা পরিচিত ভাব এসে জড়ো হয়। যেন আগেও একবার, কখনও এজন্মে কিংবা আগের কোনও জন্মে কিংবা...কিংবা... কখনও এসেছিলাম এখানে। ঠিক এই রাস্তা দিয়ে, এই পথ মাড়িয়ে, ছায়ার আড়াল ভেঙে দীর্ঘ পথ আমি হেঁটেছি। জানিনা, কেন এমন হয়! কিন্তু খুব ভালোও লাগে। ঘর ছেড়ে বেরানোর যে মনখারাপটি ছিল, সানস্ক্রিন লোশনের জন্য জিইয়ে রাখা মনখারাপটিও ততক্ষণে ফিকে হয়ে গেছে। শুধু মাঝেমাঝে সানগ্লাসের প্রয়োজন মনে হচ্ছে কিন্তু কী আর করা যাবে! ওটাও বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছে। ট্রেনের মধ্যে আমার ঘুম হয় না কিছুতেই। মনে হয়, যদি ঘুমিয়ে পড়ি আর ভুলে যাই নামার কথা! যদি অন্ধকার দেখে, সবাই ঘুমোচ্ছে দেখে ট্রেনও ঘুমিয়ে পড়ে! আর এই ঘুম দীর্ঘ কুড়ি বছর আর কিছুতেই ভাঙতে না চায়! না বাবা দরকার নেই!সারাটা ট্রেন ঘুমোচ্ছে, কী অসাধারণ,  অসাধারণ সব শব্দ! নাক ডাকার, মাথা চুলকানোর, আড়মোড়া ভাঙার... নামার শব্দ আর ওঠার শব্দ দুটো খুব ভালো লাগে... যে নেমে গেল মানে গন্তব্য এসে গেল তার... আর যিনি উঠলেন এইমাত্র তাঁর তো দুচোখ ভর্তি সুদূরের রোদ... আলো! আমার কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর চেয়ে এই যাওয়াটুকু, এই মাঝের পথটুকু আরও বেশি ভালো লাগে...

অবশেষে গন্তব্য। হোটেলে ঢুকে প্রথম বাথরুম দেখে নাও। ঠিক থাকলে ঠিক... নাহলে মাথা খচে ভূত। তারপর ব্যালকনি। কিছু ব্যালকনি সমুদ্রের দিকে মুখ করে ঘোরানো...  কিছু আবার বন পাহাড়ের দিকে । আমি জীবনে এমন ব্যালকনিও পেয়েছিলাম যার মুখ ছিল পচা নর্দমার দিকে... অসংখ্য নোংরার সঙ্গে তার কী কথা কে জানে! যাইহোক,  এবার লাগেজ রাখতে যতটুকু সময়... হইহই করে হোটেলের বারান্দা,  রিশেপশন, রান্না করার জায়গা, বাসন ধোয়া মাসি, ঝাড়ু মারা মেয়ে সবার সঙ্গে ভাব জমানো। এটা অবশ্য আমার একটা বদস্বভাব, সবাই বলে। আমি অবশ্য কখনও গা করি না। বলা তো মানুষের কাজ! কিন্তু এদের সঙ্গে ভাব না জমালে আমার জায়গাটি অপরিচিত ঠেকে...  আর জামশেদপুরের জন্য মনখারাপ আরম্ভ হয় ঠিক তখনই!  তারচেয়ে এই ভালো! তাইনা? 

কোথাও বেড়াতে গেলে, আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ভোর সকালটি কিংবা মধ্যরাত। অবশ্য মাঝরাতে বেরানোটা ভয়ের কোনও কোনও ক্ষেত্রে। সব জায়গাতে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু উটি আর অমরকণ্টকে এই ভয়টা একদম ছিল না। যখন খুশি বেরিয়ে পড়। আর চাঁদের আলোয় লুটোপুটি খাওয়া রাতের নর্মদা কিংবা উটি হোটেলের সামনের কাঁপতে থাকা সবুজ, কুয়াশা ভেজা লন...আহা! অপূর্ব!  মনেহচ্ছে এখুনি ছুটে চলে যাই! আবার যখন পুরীতে ভোর চার- পাঁচটে! মনে হয় জনম সার্থক! নৌকোদের ফিরে আসা... নীলাভ ভোর আলো মাখচ্ছে একটু একটু করে...সোহাগী... ঠিক যেন এই নৌকো রোদ নিয়েই ফিরছে। নৌকো করে আলো এলেন! খোল ভর্তি শাঁক, ঝিনুক, মুক্তো... আহা! কী করে বোঝাই এই সীমিত অক্ষরে! 

যাইহোক,  মুক্তোর কথা এলো যখন একটা ঘটনাতে আসি। সালটা আঠেরোর। চিল্কা হ্রদে ভাসছি। চারপাশের মানুষের কোলাহল,  বোটের শব্দ-- আমার মোটেও ভালো লাগেনি। কেননা প্রচুর রোদ ছিল। মেঘলা আকাশ বেড়ানোর পক্ষে খুব ভালো।  এটা অবশ্য আমার মনেহয়! মুখ গোমড়া করে বসেছিলাম। আরে বাপরে! প্রায় আমার গা ঘেঁষে ইয়া বড় একটা ডলফিন! ডিগবাজি মারছে। ঠিক যেন, ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া '৯'  কার। এতদিন পর এই হারিয়ে ফেলা স্বরবর্ণ টিকে খুঁজে পেয়ে মন তো খুশি হওয়ারই কথা। একটা ডলফিন আসার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি এসে হাজির। জল নিয়ে খেলা করছে নাকি আমাদের খেলা দেখাচ্ছে! ততক্ষণে মনখারাপ গায়েব!  দিলখুশ! দেখলাম চারপাশে অসংখ্য পাখি উড়ছে... মেঘে আর রোদের লুকোচুরি আছে আর আছে অসংখ্য ভালোলাগা। আমাদের বোটের ড্রাইভার যুবকটিও খুব ভালো। আমি ওড়িয়াতে তাঁর সঙ্গে কথা বলাতে কী খুশি! কী খুশি! এটা ওটা দেখাচ্ছে। বোঝাচ্ছে। চিল্কার ভেতরে একটা ছোট্ট দ্বীপে এনে আমাদের নামাল। খুব সুন্দর দ্বীপটি। ওই দ্বীপের চারদিকে চিল্কার জল। তারমধ্যে একটা বিরাট ফাঁকা মাঠ। ত্রিপল টাঙিয়ে  ছোট ছোট পসরা সাজিয়ে বসেছে অনেকেই। নানারকম সামুদ্রিক মাছ, ঝিনুক,  শাঁখ, মুক্তো। একটা জ্যান্ত ঝিনুক ভেঙে তার ভেতর থেকে আস্ত মুক্তো বের করে আনছে। পনেরো শো, দু'হাজার তার দাম সেই মুক্তোর। বেশ সস্তাই। ভাবলাম, এই অরিজিনাল মুক্তো তো পাওয়াই যায় না! কিনে নিই বেশ কিছু। ওরা বলল হোটেল থেকে টাকা সংগ্রহ করে নেবে, পরে এসে। তবে তো আর কোনও অসুবিধা নেই। আমিও লাফাচ্ছি। আর ইশারাতে ড্রাইভার যুবকটি 'না'  বলছে। কিন্তু আমি তো তখন বেহুঁশ প্রায়। দেখেও দেখছি না ভাব। শেষে নিরুপায় সে প্রকাশ্যে বারণ করল আমাকে। তারপর সে কি কান্ড! ওখানকার সমস্ত দোকানদার তেড়ে আসে ছেলেটির প্রতি। ধমকায়। বকে। গায়ে হাত পর্যন্ত তোলে। ওদের ব্যবসা নষ্ট করে দিল... 'দেখি নেবা শলা'...শাসায়। আমরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসি। ফেরার পথে ছেলেটি জানায়, আসলে, এসবই ঝুটো মুক্তো। এরা ঝিনুকের খোলের মধ্যে আগে থেকে ঢুকিয়ে রেখেছে। তাই ও বারণ করেছিল।  আমরা যদি কিনতাম, এই ছেলেটিও প্রতি মুক্তা পিছু ৪০০ টাকা করে পেত। বকশিস।  কিন্তু কেন জানিনা, দু ঘন্টার পরিচয় তাকে এত সাহসী করে তুলল? নাকি তাঁর মাতৃভাষায় কথা বলেছি, সেই টানে? জানিনা... কিছু বিষয় না জানাই ভালো...  

প্রকৃতির মতো মানুষও বৈচিত্র্যময়।  আর যেকোনো ভ্রমণে আমার এই মানুষদের খুব ভালো লাগে। গোমড়া মানুষ,  রাগী মানুষ,  কম রাগী,  হাসিখুশি, আলাপী মানুষ,  গায়েপড়া মানুষ,  ওভার অ্যাকটিং করা মানুষ, বন্ধু মানুষ...  হিংসুটে মানুষ, লোকঠকানো মানুষ...  আমার মত মানুষ,  বোনের মত মানুষ...  ভাইয়ের মতও আছে! মানুষের এই দুনিয়াতে কিলবিল করে হেঁটে যাওয়া, পার হয়ে যাওয়া প্রতিটি মুহুর্ত এক একটি মানুষের সাথেই ভ্রমণ গড়ে ওঠা। তার সঙ্গে মিশে যায় প্রকৃতির বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। ব্যাকগ্রাউন্ড। আর এই ভ্রমণের সময় তাঁরা দেবদূত টাইপের। কখনও  গাইড করতে আসে।  ওদের চোখ দিয়ে দেখি, আমরা কথা বলি অপরিচিত দৃশ্যের সঙ্গে ভাব জমাই, আবার ওঁদের কথায় খুঁজে নিই আমাদের আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা ফেরার পরে এই জায়গাটির উপস্থিতিকে। এই অপরিচিত জায়গায় আরেকজনের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে যায়। তিনি হলেন ড্রাইভার।  কোথায় দাঁড়াতে হবে, কোথায় খেতে হবে, কোথায় এসে জমা হবে দৃশ্য সঅঅঅব তাঁর নখদর্পণে।  এঁদের প্রতি আমার একটা মুগ্ধতা আসে... ভালোলাগাও... 

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়, যেরকম মনখারাপ হয়... ফেরার সময়ও তাই হয় আমার...তখন হোটেলের রুম, হোটেলের ব্যালকনি, গাড়ির ড্রাইভার,  গাইড করা ছেলেটি এমনকি বয়ে যাওয়া সময়টির জন্যও মনখারাপ এসে জোটে। কখনও মনে পড়ে, নির্জন পথটির কথা। কখনও বা দার্জিলিং এর রামধনুটির কথা। এই ফেরার পথটি বিষন্নতায় মোড়া। অভিমানে ঘেরা। তখন মনকে সাত্ত্বনা দিই, ফেরা তো হবে আবার! তখন না হয় আরও একবার মুখোমুখি হওয়া যাবে ছেড়ে যাওয়া সময়ের বিন্দুটিকে। কিন্তু তা আর হয় না। হয়ত হবে! দেখা যাক! ফেরার সময় গড়ে ওঠে আরও অসংখ্য ভ্রমণ। এই চলে যাবো আমাজনের গভীরে। এই ম্যারিয়নের সবুজ খাত থেকে ছিঁড়ে আনবো ভেজা শ্যাওলার গন্ধ। এই মঙ্গল গ্রহ পেরিয়ে ইউরেনাস নেপচুন থেকে তুলে আনব একমুঠো আশ্চর্য।  যাওয়াটা তো এমন কিছু ব্যাপারই না! শুধু বেরোতে জানলে হল... শুধু পিছুটানকে একটু আড়ালে ডেকে দুটো লেবেঞ্চুস ধরিয়ে দিলে হল। মেনে নেবে সে। তখন শঙ্খ চিলের ডানায় ভর করে, বুড়ো আংলার সঙ্গে প্ল্যান করে, বুনো শালিকের পায়ে নাচতে নাচতে পার হওয়াই যায় শত সহস্র মাইল স্টোন। ব্যাপারই না...আর তখন মনেহয়, শুধু পা আর চোখের শত্রুতা মিটে যাক আর আমি পরিযায়ী হয়ে যাই কিংবা যুগযুগান্তের শ্রমণ! 


7 comments:

  1. ঠেকাতে না ঘুরলেও যে এতো ভালো ভ্রমণ হয় এতে আমি অভিভূত

    ReplyDelete
  2. ভাল লাগল বেবী। তারচেয়ে অটো ভাল। সাইকেল কিন্তু মন্দ নয়। আমরা বাই নেচার এক একজন ভ্রামনিক - ভ্রমন তা সে বাস্তবে হোক কিনবা কল্পনায়, না ঘুরে থাকতে পারিনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক তাই... পথ নেই তো কী হয়েছে, মন তো আছে...

      Delete
  3. খুব ভালো লাগলো রে

    ReplyDelete

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম