ঘাম
(১)
আটটার মেট্রোটা টালিগঞ্জে পৌছালে,
এক রাশ ভিড় ঠেলে রিনা বেড়িয়ে আসে। একটা হাতে ব্যাগের দড়িটা ভালো করে
জড়িয়ে নেয় সে। আরেকটা হাত দিয়ে কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত ক্রস করে লক্ষণ রেখা সৃষ্টি
করে নেয় । শুধু ব্যাগ সামলালে তার চলবে না। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে কলকাতায়
যেরকম ঘাম সৃষ্টি হয় তা আর কহতব্য নয়। ঘাম থেকে ঘাম বাড়ে। তোমার ঘাম, আমার ঘাম,
সমস্ত ঘাম মিলেমিশে এক হয়ে যায়। মানুষ ঘামছে, বিশেষ ভাবে ঘামছে, দরদরিয়ে ঘামছে।
লোকে ঘামছে, ঘাম মুছছে, চালান করছে। এ সব রিনা দেখছে, কিন্তু স্বাধীন ভাবে ঘামতে
পারছে না। ভিতর থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি
লাগছে অথচ ঘাম হচ্ছে না। তাতে গরমের কষ্টটা আরও বাড়ছে। শরীরের প্রতিটি অংশ বাঁচিয়ে
যখন সে স্টেশনের ফাঁকা জায়গাটাতে এসে দাড়ায়, তখন তার জমে থাকা ঘাম ধীরে ধীরে
বেরোতে থাকে।
একটা কথা ভেবে স্বস্তি পায়, যে তাকে কাল
অফিস যেতে হবে না। কাল
শনিবার, ছুটির দিন। আজ বেশি রাত পর্যন্ত জাগতে পারবে, কাল দেরি করে উঠতে পারবে।
রিনার আজ রাতে বিয়ার খেতে খুব ইচ্ছে করছে। বাইরে নয়, বাড়িতে বসে পা ছড়িয়ে। কিন্তু
বিয়ার কিনতে যাওয়াটা খুব চাপের। লাইনে দাড়ালে সেই ঘাম আটকে রাখার বিচ্ছিরি অবস্থার
মধ্যে আবার পরতে হবে। তাই মন চাইলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। হাঁটতে হাঁটতে রিনা ভাবে
ঘরে কি কি রান্না আছে? সকালবেলা মিনতিকে চিকেন
বার করে দিয়ে এসেছিল। বলেছিল অনেকটা একসাথে করে রাখতে, কালকের জন্য। শনি ও রবিবার
মিনতি আসবে না, তাই অনেকটা করিয়ে রাখে, যতটা রান্না এড়ানো যায়। একবার ভাবে পাড়ার মোড় থেকে জিলেপি নিয়ে
যাবে। তারপরই ভাবে এতরাতে জিলেপি খেলে অম্বল হয়ে যাবে- এবং পিছিয়ে আসে। জিলেপির
কথা মনে হওয়াতে, শেখরের অফিস ফেরত জিলেপি নিয়ে আসার কথা মনে পরে যায়। শেখরের সাথে
রিনার ডিভোর্স হয়েছে প্রায় বছর পাঁচেক হল।
“কেন ডিভোর্স দিতে চাও? কি অসুবিধা হচ্ছে?
সবই তো ঠিক আছে। তুমি কি অন্য কারুর সাথে আফেয়ার করছ?”
“নিজেকে জানতে। অসুবিধা না হওয়ার অসুবিধা।
ঠিকই তো আছে সব- তুমি,তোমার বাড়ি, তোমার চাকরি। হ্যাঁ আফেয়ার তো করছি নিজের সাথে।”
--- ভাবনার পাকদণ্ডীতে ঘাম আসে। ঘামেরা
বসবাস করে। ঘামেরা লেগে থাকে। শরীর থেকে বেরোতে পারেনা।
“একটা বাচ্চা নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে”-
প্রাচীন কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে।
“এত খেটে খুটে আসে, শরীরটার উপর দিয়ে কত
ধকল যায়, ওকে কিছু বোলোনা। একটা ছেলে পুলে
হলে বেঁচে থাকার মানেটাই বদলে যাবে। কি অপার্থিব আনন্দ বুঝতে পারবে।”
“আর পার্থিব আনন্দগুলি”- রিনা দ্রুত গলায়
হাত বুলিয়ে দেখেছিল তার শরীরের ঘাম শুকোতে শুরু করেছে।
(২)
চার বছর হয়ে গেছে,
রিনা এই ফ্ল্যাটটা নিয়েছে। প্রথম
দুই বছর ঠাকুমা সঙ্গে ছিল।
ঠাকুমা
মারা যাবার পর রিনা এখন একাই থাকে।
সপ্তাহের
পাঁচ দিন মিনতিদি রান্না করে, তাই শুক্রবারটা সে বেশিই করিয়ে রাখে। শনিবার
গানের ক্লাস নেয় রিনা, কচি কাচা গুলো দুপুর তিনটে
নাগাদ চলে আসে।
রবিবার
রিনা শুধু মাত্র সিনেমা দেখে,
এটা তার একান্ত “মি- টাইম”। অত্নু
একটা নতুন সিনেমা দিয়েছে – আসগার ফারাদির “আ সেপারেশন”,দেখতে হবে।
“জানি না তোর কেমন লাগবে? ভালো নাও লাগতে
পারে।
একটা
অন্য দৃষ্টিভঙ্গি পাবি।”
“ভালো লাগবে না বলছিস। তাহলে
দিচ্ছিস কেন? তুই যখন জেনে গেছিস, ভালো লাগবে না-তাও দিচ্ছিস! ”
“না তুই ইরানীয়ান ছবি ভালবাসিস তাই।”
ফ্রিজ খুলে ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নেয় রিনা। বসার
ঘরে পাখা চালিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে।
বাইরের
অন্ধকার আকাশ দেখে বোঝা যায় না মেঘ করেছে কিনা। মেঘকে
কেমন সুন্দর ঢেকে ফেলতে পারে অন্ধকার।
মেঘে
মেঘে ঘষা লেগে বিদ্যুৎ হবার আগে, কখন কখন মেঘেরা ঘামে। একে
একে অপরের ঘাম গায়ে মেখে নেয়।
এই
সব অবান্তর চিন্তা রিনার মাথায় ঘুরতে থাকে। ভালো করে শাওয়ার চালিয়ে নিয়ে,
স্নান করে রিনা।
ধুলো,বালি, শায়াওলা মেখে সর্বংসহা, আপন
করে নেওয়া পৃথিবী হতে চায় না।
পৃথিবীর
গন্ধ,
শাড়ির পাড়ের গন্ধ , থিক থিকে চামড়ার গন্ধ ঠাকুমার
সাথে চলে গিয়েছে।
রিনা প্রতিবার ভাবে ঠাকুমার মৃত্যুদিনে সে
কি করবে?
সে কিছুই ভেবে উঠতে পারেনা। এবারও
সে কিছুই ভেবে উঠতে পারেনি; এ কথা ও কথা ভাবা,
ছবির কাছে বসে থাকা ছাড়া। ঠাকুমাকে
সে জোর তার ভালো লাগা জোয়ান বেজের গান শুনিয়েছিল।
“শোন ছেমরি, কৃষ্ণা
চট্টোপাধ্যায়ের অতুল্প্রসাধী শোন।
”
‘ কে আবার বাজায় বাঁশি
এ ভাঙ্গা কুঞ্জবনে
হৃদি মোর উঠল কাঁপি
চরণের কোন রনণে।‘
রিনা এত কথা ভাবতে ভাবতে পিঠে হাত দিয়ে দেখে
ঘাম হচ্ছে কি না? কিসে ঘাম হবে রিনা এখন উদ্ধার
করতে পারেনি ।
এটা
কি তার অসুখ? সমস্ত লোক এই গরমে ঘামছে, সেখানে রিনার
কনো ঘাম নেই।
কিছু
স্যালাড কেটে নেয়।
ফ্রিজ থেকে ব্রেড
আর মিনতিদির করা চিকেন টা তুলে নেয়।
“ ভাত খাও। দেখ ঘরের পাঁচটা লোক ভাত
খাচ্ছে, তুমি কেন আলাদা খাবার নাও, ব্রেড আবার ডিনার নাকি?”
“তুমি তো আর বানাচ্ছ না। তোমাকে তো বানাতে
ববলছি না, আমি তো নিজে বানাচ্ছি”
“তুমি তো আমার কথা শুনবে না। বলে কি লাভ? তুমি
তো জেদ ধরে আছ।”
উপরের
পাখাটা জোড়ে ঘুরছে না, জানলাগুলো বন্ধ। খাওয়ার পরে ল্যাপটপের সামনে বসা রিনা তাও ঘাম আসছে না-এত
গুমোট গরমেও।
সামনে
অন্ধকারে নিয়নের মত জ্বলছে ফেসবুক পেজ।
অজস্র
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেন্ডিং।
সবাই
বন্ধু হতে চায়।
অজস্র
বন্ধু
“হাই
থ্যাঙ্কস, ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার জন্য”
“ধন্যবাদ দেবেন না”
“আচ্ছা আপনি কি করেন? আপনি কোথায় থাকেন?”
…………………………………………………………
“উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আমি কি কোন ভুল প্রশ্ন করেছি?”
“আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুভরাত্রি।”
“কেন? আমি তো বিরক্তিকর কিছু বলিনি। ওহ
, আই থিঙ্ক উ আর এ ফেমিনিস্ট ”
ফ্যানটা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরের
সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পরেছে।
দূর
থেকে একটা লড়ির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
রিনা
ব্যাল্কনিতে এসে দাড়ায়।
চাঁদ
খোঁজার চেষ্টা করে।
কলকাতার
আকাশে চাঁদ পাওয়া যায় না।
গলিতে
চায়ের দোকানে ছোট্ট জলসা বসেছে- এত রাতেও সেখান থেকে
একটা গরম উত্তাপ উপরে উঠে আসছে।
রীনা
গলায় হাত রাখে, এখনও ঘাম আসছে না।
পড়তে পড়তে পাঠকের মনে অনেক প্রশ্ন আসবে।
ReplyDeleteআর তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে জন্মাবে নতুন গল্প।
উত্তরাধুনিকতার ছোঁয়া পেলাম... কিছু বিদেশী স্বল্প-দৈর্ঘ্যের ছবি যেমন হয়।
ধন্যবাদ জয়দীপ
Deleteযে সব গভীর প্রশ্ন আপাতঃ অবান্তর। আত্মমগ্ন না হোলে যাদের খোঁজা যায় না। আত্মমগ্ন হতে গ্লানি হয়
ReplyDeletethik
Delete