Friday, May 31, 2019

আমার শীতের মেঘমল্লার - মণিমেখলা মাইতি







বোধহয় ভোর সাড়ে চারটে। সরু একফালি ট্রেন সাবধানে হুইশল দিতে দিতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল স্টেশনে। ঘুরঘুটে অন্ধকার বাইরে। সঙ্গে তুমুল কনকনে হাওয়া। আমরা দুই প্রাণী আর দু -একজন ( বোধহয় আমাদের মত বেকায়দায় পড়েছিল) স্টেশনে নেমেছি। নামার আগে ট্রেনের গার্ডের কাছ থেকে পাশপোর্টগুলো ছিনিয়ে নিয়ে এসেছি। ট্রেনে ওঠার পরে পরেই গার্ড এসে ওগুলো বগলদাবা করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কী জানি হয়তো ভেবেছিলেন ট্রেন থেকে লাফ টাফ মারতে পারি। এদিকে এত সরু আর ছোট বার্থ আমার কর্তার পা টানটান হল না। এইজন্য বেঁটে হওয়ার যে কিছু সুবিধা আছে সেদিন ভালোই বুঝলাম। উন্নতশির-ওয়ালাদের জন্য এ ট্রেন মোটেও নয়, এ আমার মত নতশির-ওয়ালীদের জন্য। ট্রেনটা জুরিখ থেকে ছাড়া ইস্তক কেমন ফাঁকা ফাঁকা। করিডরের আলো আঁধারিতে হাঁটলে গা ছমছম করে। ভেতরের বার্থগুলোয় হালকা আলো জ্বলছে। আমাদের সঙ্গী এক সুইস ছেলে হাতে একটা বই নিয়ে উঠেই কম্বল চাপা দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। আমরা এত কেতামারা ট্রেন জার্নিতে অভ্যস্ত নই। খেয়ে একটা বই নিয়ে বার্থে চড়ে বসব। আপার বার্থ হলে তো কথাই নেই। ট্রেনের দুলুনিতে দোল খেতে খেতে মাথার ওপর আলো জ্বালিয়ে সঙ্গী যাত্রীর দাঁত খিঁচুনি খেতে খেতে পত্রিকা বা গল্প বই পড়ব। ট্রেন কোন স্টেশনে থেমে যাবেই। 'এই চায়ে, এই চায়ে', 'এদিকে নয়, ওদিকে ওদিকে'--চেঁচামেচি, ছুটোছুটি, ওঠাউঠি দেখতে মুখটা সাপের মত বাড়িয়ে দেখব। আবার ভোঁওওও আওয়াজ হলে পাশের বার্থের ঘুমের বিঘ্ন ঘটা লোকটির দাঁত খিঁচানো খেতে খেতে সবাইকে লাথি মারতে মারতে একপ্রস্থ বাথরুম থেকে এসে তবে ঘুমোনোর তোড়জোড় করব। তখন দেখব আমার কম্পার্টমেন্টর জমিয়ে লুচি-মাংস খাওয়া পার্টি অঘোরে ঘুমুচ্ছে। এমন ম্যাদামারা ট্রেনযাত্রায় ঘুম আসে?

একে ট্রেনের কূপতো নয় যেন জেলখানা। তায় আলো সব লজ্জায় টিমটিম করছে। লোকজন নেই। স্টেশনে দাঁড়ানোর ব্যাপার নেই। দাঁড়ালেও সেটা স্টেশন না প্রার্থনার মন্দির বোঝার উপায় নেই। সবাই নীরবে ধ্যান করছে। সেখানে কেউ চা-কফি খায় না, কেউ বিক্রিও করে না। কেউ মুখে শব্দও করে না। চারিদিকে যেন শ্মশানের নৈঃশব্দ্য। তায় পাশপোর্টগুলো বগলদাবা করে নিল সীমান্ত পেরোবার আগে। কী করে বিশ্বাস করি!! যদি কেটে পড়ে ওদুটো নিয়ে গার্ড, এ বিদেশ বিঁভুইতে কি ভিক্ষে করে বেড়াব? এদিকে পকেটের অবস্থা বেশ কাহিল। ওইজন্যতো কম পয়সায় রাতের ট্রেন নিতে হল। আনন্দের আতিশয্যে খেয়াল ছিল না ভোর সাড়ে চারটে মানে সূর্যদেবের আসতে তখনো দু-তিনঘন্টা বাকি। সবে বিজয়া রায়ের 'আমাদের কথা' পড়েছি। তাই যেতেই হবে সালজবুর্গ। রোমান্টিক শহর। চুপি চুপি একটা কথা বলে দিই ওখানে যাওয়ার কিছুদিন আগেই 'সাউন্ড অফ মিউজিক ' এর নাম শুনেছিলাম। কোথায় আর জানব? ওই সুদূর মফসসলের বর্গভীমা সিনেমাতে যে কটা বাংলা ছবি আসত, মা বলত সব রাতের ছবি। আলো এত কম। তাই ওসব ইংরেজি সিনেমা আমাদের মত মধ্যবিত্তের জন্য ছিল না।

ডিসেম্বরের ভোরে নেমেই মালুম হল ঠাণ্ডা কারে কয়? বাপরে আল্পস নিংড়ে যেন সব ভূত-পেত্নী এসে আমার চারিদিকে নৃত্য করছে। আমার গায়ে গণ্ডারের মত সব আস্তরণ। একে একে সব চাপিয়েছি, যা ছিল অবশ্য। দুটো দাঁতের পার্টি যেন সেই অনেককাল আগে টিভিতে দেখা 'হিতাচি' এয়ারকণ্ডিশন মেশিনের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ঠকঠকানি থামেই না। কাঁপতে কাঁপতে একটা কাঁচঘেরা ওয়েটিং রুম পেয়ে কোনমতে বসে পড়েছি। আমরা দুজন। আর একজন মহিলা আর বয়স্ক লোক। আমার অমন ঠকঠকানি দেখে মহিলা অবাক হয়ে আমায় দেখছেন একবার, একবার আমার পায়ের ড.স্কোলস। ওসব পা ঢাকা জুতোটুতো আমার বিশেষ চলেনা। কী ভাবছেন কী জানি! একটা চাদর বের করে ফের মুড়ি দিলাম। কাঁপুনি কমার কোন লক্ষণ নেই। তারপর আর কিছু জানিনা। আমার কর্তা বলেছিল আমি নাকি কাঠের বেঞ্চে লম্বা হয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর ওই মহিলা কিছুক্ষণের জন্য গবেষণার বস্তু পেয়েছিল।

সে যাক গে। সকাল হল কিন্তু সূর্যদেব দেখা দিলেন না। সেদিন তাঁর পাঁজিতে ডেট নেই বেরোবার। কুছ পরোয়া নেহি। হোটেল খুঁজতে চললুম। সেও এক ঝামেলা। কম পয়সায় চাই, সঙ্গে আবার ডবলিউ সি ( ওয়াটার ক্লোজেট)থুড়ি সাদা কথায় বাথরুম চাই। নয় রুম একদিকে, টয়লেট একদিকে( সেখানে কিন্তু কোন জলের ব্যবস্থা নেই), স্নানের জায়গা আরেকদিকে-- এসব বাবা চলবেনা আগেই নিদান দিয়েছি। এমন হোটেল দেখলে আমার আবার আমাদের প্রতিবেশী ঘোড়াইদের বাড়ির কথা মনে পড়ে। তাদের বিশাল বাড়ি, পুকুর। কিন্তু বাথরুমটি তিনশ মিটার দূরে আমাদের পুকুরের কাছে। সেখানে জলের ব্যবস্থা ছিল না। সবাই একটা ছোট্ট ঘটিতে জল নিয়ে আসত। ওই ছোট্ট ঘটি দেখলেই কী যে হত আমার কী বলব। কতশত প্রশ্ন ওই ছোট মাথায় ধেয়ে আসত। আবার হোটেলে যেন সকালে প্রাতরাশ দেয়। আরে বাবা পকেটে ওইতো কখানা ইউরো। এক ঢিলে তিন চার পাখি মারার ব্যবস্থা করতেই হবে। কপাল ভালো বটে। একখানা পাওয়া গেল। সকালে খেতেও দেবে আবার সঙ্গে জলের ব্যবস্থাসহ বাথরুম আছে। কোনমতে স্যুটকেস নামিয়ে, শাড়ি চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লুম শহর দেখতে। যে যাই বলুক বিদেশ বিঁভুইতে শাড়ির কোন বিকল্প নেই। নিজেকে কেমন ফিল্মস্টার ফিল্মস্টার মনে হয়।

অস্ট্রিয়ান আল্পসের কোলে অসম্ভব সুন্দর শহর সালজবুর্গ। শহরের প্রতিটি কোণা থেকে সুর ঝংকৃত হয়। সুর গলে পড়ে সালজ নদীর সবুজ জলে। সালজ মানে(salt)। আল্পসের কোল বেয়ে শহর ছুঁয়ে আলতে করে চলতে থাকে এ নদী। তাকে পাহারা দেয় পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্যাকার দুর্গ Hohensalzburg Fortress। এ শহর সুরসম্রাট মোৎসার্টের শহর। সাউন্ড অফ মিউজিক এর শহর। মিরাবেল গার্ডেনের আনাচে কানাচে কান পাতলেই সুর শোনা যায়। সুর উঠে আসে মোৎসার্টের বাড়িতে সাজিয়ে রাখা শত শত পিয়ানো থেকে। সুরের ছন্দে আবর্তিত হয় ভ্যান গঘের ক্যানভাসের মত এ শহর।

প্রথম দিন নির্বিঘ্নে কাটল। দ্বিতীয় দিন চললুম ওই পাহাড়ের ওপর দুর্গ দেখতে। এদিকে দুপুরে ট্রেন ধরার তাড়া আছে। সন্ধের ট্রেন ধরতে গেলে পকেটটা ভারী হতে লাগে। তাই সুটকেস বগলদাবা করে হোটেলকে বিদায় জানিয়ে ট্রেনের মত লিফটে উঠে গেলাম ওপরে। পুরো শহরটা আমার চোখের নীচে। চারিদিকে ইতিউতি আল্পস। তাদের জড়িয়ে আছে মেঘ। পরম নিশ্চিন্তে মেঘদল পাহাড় গুলোকে জড়িয়ে জড়িয়ে ওপরে উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার জোগাড়। হুহু করে কালো মেঘ এসে কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে। রেখে যাচ্ছে নৌকোর পাল ছিঁড়ে দেওয়া দামাল হাওয়া। বুঝতে পারছি অবস্থা সুবিধার নয়। কিছুক্ষণ পর নামার তোড়জোড় শুরু করলাম। নীচে নেমে বেরোতে না বেরোতে তুমুল বৃষ্টি আর সাথে ঝোড়ো হাওয়া। মেঘপিওনের দলের কব্জায় আল্পসের শৈলশিখর। কনকনে ঠাণ্ডায় ছাতা ধরে রাখা দায়। সাহেবদের সব লম্বা লম্বা ছাতা মটমট করে ভাঙছে। আমাদের বাপু মহেন্দ্র দত্ত আর কে সি পালের দম আছে বলতে হবে। ওই ফিরিঙ্গি ঝাপটা হাসিমুখে সহ্য করছে।

কিন্তু বিপদটা যে অন্য জায়গায় বুঝিনি। স্টেশন যেতে বাস 5 ধরতে হবে। সে আর কেউ বলতে পারছে না। যাকেই বলছি বাস ফাইভ, ইংরেজি শুনে ঘাড় ঝাঁকিয়ে ভাঙা ছাতা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। ওদিকে তো ট্রেন ধেয়ে আসছে সালজবুর্গ স্টেশনের দিকে। আমরা দুজন বৃষ্টিতে, ঠাণ্ডায় একেবারে অসহায়। মধুসূদন দাদাকে ডেকে যাচ্ছি--- বাস ফাইভ পাইয়ে দাও বাবা। কোথায় মধুসূদন দাদা!। দাদা তখন নিজে বাঁচাতে ব্যস্ত। আমার কর্তা বহু আগে কয়েকমাসের জন্য জার্মান শিখেছিল। ওই সিকি জার্মান জ্ঞান নিয়ে সবাইকে বুশ ফাইভ, বুশ ফাইভ বলে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা খোঁজার মত পাঁচ নম্বর বাস খুঁজছে ইংরেজি ছেড়ে। ওদিকে আল্পস গলে যায় কিন্তু জার্মানদের মেজাজ গলে না। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে, ঝড়ের বেগ বাড়ছে, ট্রেন ধেয়ে আসছে, পকেটে ইউরো ফুরিয়ে আসছে কিন্তু কী করে যাব স্টেশনে তার আশা নেই। শেষ অবধি মধুসূদন দাদা দেখা দিলেন এক ঝাড়ুদারের বেশে। ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন কোথা থেকে ধরতে হবে। দুগ্গা দুগ্গা করে স্টেশনে এসে জার্মানদের তুলোধোনা করে ট্রেনে চড়ে বসলুম। ট্রেন ফিরিয়ে নিয়ে চলল জুরিখ।

ভিজে জুতো খুলো পা ছড়িয়ে পুজোবার্ষিকী আনন্দবাজার পত্রিকাটা সবে খুলেছি। একী!! আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে তুষারের কণা। সারা অস্ট্রিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে বছরের প্রথম তুষারপাত। মুহূর্তের মধ্যে ঢেকে যাচ্ছে ঢেউখেলানো উপত্যকা, সবুজ ঘাস, পাইন, ঢালু ছাদওয়ালা বাড়িঘর, গম্ভীর আল্পস।।গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ জমা হচ্ছে স্টেশনে। ডুবে যাচ্ছে বেঞ্চ, ঢেকে যাচ্ছে দোকান। এ এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। চোখের পলক ফেলতে পারছি না। শুধু ভাবছিলাম এমন সুন্দর দেশ কেন তবে ইংরেজি বলে না! ট্রেন সরে সরে যাচ্ছে দেশের সীমা রেখার দিকে, ছুটছে অন্য দেশের পানে। আমি ছুটছি উল্টো দিকে প্রাণপণ। আমার মন তখন আকুলিবিকুলি করছে ওই আল্পসের গায়ে জড়িয়ে থাকা মেঘদলের জন্য।মেঘমল্লারে আমি ভিজছি, আমি ভিজছি। আমার কোন থামা নেই। আমার কোন ট্রেন ধরার তাড়া নেই। স্টেশন আমি হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। আমাকে যেতে হবে মাইলের পর মাইল।



No comments:

Post a Comment

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম