Friday, May 31, 2019

আমি এখন জয়ের পথে -- রুমা তপাদার





‘বেশ তাহলে নিজের কথা বলা কোনও পথ হতে পারে না, মানবদা / কোনও পথ হতে পারে না'... এই পথ না হওয়ার পথেই আমিও বেরিয়ে পড়ি 'পড়ে থাকা রাস্তার খোলামকুচি' সঙ্গে নিয়ে নানা প্রতীক্ষা প্রত্যাশার মানবিক চাঞ্চলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাই তাঁর হাত ধরাধরি করে  প্রত্যেক পঙ্‌ক্তিতে পঙ্ক্তিতে 'আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী' ...সুদূরমগ্নতাকে চরিতার্থ করার সুবাসে মানসভ্রমণ-সৌরভে শ্বাস টেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ভাবনার মানসভ্রমণ-আশ্বাসে    
একমাত্র এই ভ্রমণজনিত বিশ্বাসটুকুই তো  "আত্মজীবনীর অংশ" হতে পারে জাদুবাস্তবতার কল্পিত পথ হাতছানি দিচ্ছে মানস-আগন্তুককে বারবার 'পথ হতে পারে না'-তে  এক এক করে পথ খুলে দেয় বারবার, বটগাছ থেকে মনস্কামনা  দোল খেতে খেতে নদীতে এসে পড়ে, নৌকায় উঠে পড়ে তৎক্ষণাৎ, আবার বাঁকা সবুজ টিপ, কাজল, শাড়ির অনুসঙ্গ ঘোর কাটতে না কাটতেই আচারগাড়ি ধরে এসে পৌঁছায় স্কুলে,  ক্লাসরুমে... পথ এবার ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে দাবানল থেকে তুষারপাত, উল্কাপাতে বিচরণ ঘটে, কবির কথায় 'স্বয়ংক্রিয় গতি', এই তো পথে ভ্রমণ আমাদের চেনা-জানা নিত্যদিনের পরিসর, আর আমাদের চিরন্তন জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তকথা ক্রমশ আমাদের প্রতিদিনের ছোট চাক্ষুষ যে ভ্রমণ কবি তাকে ধরেছেন বুক দিয়ে জীবন-সীমার চারপাশে আলোকপাত করেছেন তিনি, আমিও সেভাবেই চোখ মেলে দেখতে শিখেছি, দেখেছি
কবি, সঙ্গীনির সঙ্গে ঝগড়া করেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন আমিও চলেছি---- রাস্তায় রাস্তায় খাবার দোকান পেরিয়ে তার 'পাণ্ডুলিপির হরফগুলো গোঁ-গোঁ করে উড়তে থাকে' 'দিন হয় আর রাত্রি হয়' মেঘের মধ্যে দিয়ে... পাক খেতে খেতে পড়ছি ' আর 'খান খান হয়ে যাচ্ছি ' কবির এই স্বগতোক্তির সঙ্গে সাধারণ সমাজ পরিবেষ্টিত জীবনে জীবন থেকে কিছুটা বাইরে বেরিয়ে এসে ভ্রমণ করে আসি আমি কবি একই সঙ্গে বারবার নিত্যকার জীবনের দেখাকে সঙ্গী করে স্বাভাবিক উদার মন মস্তিষ্ক-বিচরণ প্রতিটি ছত্রে ছত্রে যখন 'খাতার পিটুনির ধাক্কায়'  হরফগুলো বেরিয়ে পড়ে, আমিও তখন কবিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি বর্তমানের প্রাপ্তিস্বপ্নকে ছেড়ে যেতে চাই, আর বর্তমানেই ঘুরপাক খাই দিন থেকে রাতে আর রাত থেকে দিনের ঐশ্বর্যের মধ্যে বর্তমানের প্রাপ্তিস্বপ্ন একমাত্র বর্তমান-বাস্তব, বাস্তবের পথ ধরেই তো কবিমন অবাস্তবতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, আমাদের সাধারণ চোখের চেনা দৃষ্টি বদলে যেতে থাকে 'সীমার মাঝে অসীমে' মধুর প্রকাশে নব চেতনার অরুণ আলোককে সঙ্গী করে কবি চলেছেন আর আমিও, প্রতিটি ভোরবেলায় এসেই কবি থেমেছেন কিন্তু আমি এগিয়ে গেছি পরের কবিতায়
'সেই ভোরবেলায় এক ঢিবির উপর ঘুম ভাঙে আমার'  জাগতিক মাত্রার বাইরে যে অতীন্দ্রিয় জগৎ  সেই ঢিবির উপর ঘুম ভাঙে কবির, আমি চোখ মেলে দেখি জীবনের মূল স্রোতের বাইরে যেতে যেতে সাধারণ উষ্ণতার খোঁজে আজ সম্পর্কের লেহাজ কোন মাত্রায় এসে পৌঁছে গেছে  'নরনারীর সম্পর্ক থেকে আগুন বেরোয়'  'অন্ধকার যে আমাকে পৌঁছে দেয়'----- 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো'-কে সঙ্গে নিয়েই চলি গঞ্জনা, বাধ্যতাকে সঙ্গী করে 'চলো পালাই'-এর সঙ্গে আমিও পালিয়ে যাই 'জলে আর চাঙড়ে / অন্ধকারে আর ধোঁয়ায়' ...সাধারণ মানুষের চেতনার সীমারেখা আলোক-পথের সীমাবদ্ধতা প্রক্রিয়াগতভাবে পার করে নিজের মর্জির উপর 'দিগন্ত ভেঙে'  সচেতনার আরোহনের দিকে এগিয়েই চলেছেন সমস্ত জাগতিক-জ্ঞান ফেলতে ফেলতে আর কুড়াতে কুড়াতে নিজেকে শুরু করেন এক ভোরবেলায় 
ভালোলাগার অঞ্জন নয়, শিশির পরি আমি ভোরের আলো থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে আত্মস্থ করি আর  চলি  পিছুটি ছাড়িনি জাহান্নামেও গেছি, দিগ্বিদিকেও 'জ্ঞান হারিয়ে বাড়ি ফিরি দিনান্তে' ...সাইড-সিন দেখে হোটেল বা রিসর্টে রেস্ট নিতে ফেরাই জানি কাল আবার 'হেথা নয়... অন্য কোথা অন্য কোনওখানে'
পরের লাইনে এসে রাত্রি হয় আমি শুয়ে পড়ি সঙ্গীর সঙ্গে 'উপায় নেই আমার' প্রেমিক যুগলের চিরন্তন বানী বুকে আঁকড়ে ধরে থাকা, কিছুতেই না আর কিছুতেই না তোমাকে ছাড়া, মিলনের পূর্বে গভীর বোধের এই মিলন, সঙ্গ-ক্লান্তি উপলব্ধির এই নিবিড় পর্যবেক্ষণ তার নিখুঁত বিশ্লেষণ, সহজ সাবলীল ভাষার টান আমাকেও সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে বলে আমি ঘুমাই আর জেগে উঠি নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভবে    
  রাস্তা থেকে পকেট আর পকেট থেকে বাড়ি অবধি আসি নামের সঙ্গে 'টয়লেট' থেকে রাস্তায় আর রাস্তা থেকে বাড়ি এসে হাতে তুলে নিই সাংসারিক যাবতীয় দায়িত্ব ভেসে চলি যোধপুর পার্ক থেকে গড়িয়াহাট--- গড়িয়াহাট থেকে নদীয়ার কেষ্টনারায়ণ, হাতে বাজার নিয়ে, ব্যাগদুটো জ্বালিয়ে দিই  তারপর লেকবাজার আর জগুবাজার, ছোটবাজার আর বড়োবাজার খোলা বাজার আর ফোলাবাজার রাজাবাজার, কাশিমবাজার বাংলা বিহার উড়িষ্যা হয়ে আমি দূরন্ত ঘূর্নির মতো ঘুরি সব শেষে জয়ী মৃদুসমীরণের মতো লাঠি হাতে তুলে নিই স্থির ভোরবেলা সময়ে
     তারপর 'লাঠি লিখিত কবিতা' আসে 'কোনও দ্বীপ, কোনও চূড়া, বিন্দু, সীমা, সংখ্যা, রঙ, বিষ, বাষ্প, মেঘ, রক্ত, জল, চক্ষু, শ্বাস, রোধ, অস্ত্র, মূল, ছিন্ন, আর্তি, নাদ, শোক, শোধ, বঁড়শি, টোপ, টাকরা, পিছু, ষড়, ষন্ত্র এদের সবার কথা শুনে লাঠি যখন ডানপাশ ফিরে শোয়, আমিও পাশ ফিরি এবং ডানপাশ আছে বলেই ফিরে শুই
কোনও যন্ত্র, যন্ত্রী, রবি, শংকর, সং, করাত, কাঠ চ্যালা, চিতা, মরা, ডোম, গুরু, দণ্ড, এমনকী কোনও লাঠিও এসে যখন ধমকায় তখন লাঠির বাঁ-পাশ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমিও পাশ ফিরি এই যে বিস্ময়ঘেরা  চড়াই উতরাই, তার সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশ ফেরা দৃশ্যটি আমাকে আমার জীবন সম্পর্কে অবগত করে 'নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু' সচিত্র উদ্ভাসিত মুখ     
ঘুমপাহাড়ি রাস্তা আর ভোরবেলার রাস্তা পেরিয়ে লাঠি সঙ্গে নিয়ে আমি  'রওনা দিই  বাতাসে তৈরি এক বইয়ের ভিতর' বইয়ের ভিতরেই তো সবচেয়ে দ্রুত রওনা দেওয়া সম্ভব
আমি রওনা দিই, ভেসে চলি মেঘের মধ্যে, পাক খেতে দেখি ঘূর্ণিঝড়,  আর দেখি বাতাসের ভিতরে যে নীলরং আছে, দেখি খাঁড়ি, খাঁড়ির মধ্যে একা নৌকা দেখি, জল আর জলবন্দি মাছ এবং মাছচোর 'ধরা পড়ার আগের পরের অবস্থা, তা থেকে পুনর্বাসনের উপায় এবং যে কোনও বয়সে চোর এবং ভালো মানুষ স্বভাবের মধ্যে যাতায়াত বজায় রাখবার উপায় বলা আছে বইতেই' ----কতটা পথ পার করে আমি আবার ফিরে এলাম এই বইপথে এক ঘোরের মধ্যে ঘুরতে থাকি আমি প্রতিদিনের গণ্ডি অতিক্রম করে করে গণ্ডির আরও গভীরতা ছুঁতে থাকি পরিচিত রাস্তায় ইচ্ছাকৃত পথ হারাই নতুন পথের সন্ধানে পরিচিত মোড়, রেজিস্ট্রি অফিস, সাধারণ সাংসারিক গ্রাম্যজীবনের অবিচ্ছেদ্য নানা ঘটনার কথার সঙ্গে আমার যাত্রা চলতে থাকে
পূর্বরাগ থেকে অভিসার আমি চলি শুধু চলে যায় 'হৃদয়ের শূন্য মন্দির' পূর্ণতা পাওয়ার লক্ষ্যে  'বিশেষ করে একটি পৃষ্ঠায় পৌঁছালে দেখা যাবে তার উপর লম্বা একটা মাঠ '----- এই মাঠের উদ্দেশ্যেই তো আমি ছুটে যাচ্ছি সমকালকে তোয়াক্কা না করে কোনও হুঁশ নেই আমার 'অন্তবিহীন পথ' পেরিয়ে যাচ্ছি চেনা-জানা নিজস্ব পৃথিবীর অপার্থিব ভ্রমণে আমি মেতে উঠেছি নিজস্ব চলিষ্ণু স্বভাবধর্মে  'নব আলোকের স্নানে'                   
     হাত-পায়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমি চলেছি, কখনও-বা অসহায়ভাবে ভাসছি চিরচঞ্চলের মাঝে স্তব্ধতা আমার ভবিতব্য নয়, আমি চঞ্চল রাগ-রক্ত-প্রেম নিয়ে দুলে উঠি  সচল জীবনের উদ্বুদ্ধ পথিক আমি 'বইটি পড়বার পরবর্তী গল্প'-তে এসে বাতাসের মধ্যে ঝাঁপ দিই আমি সাঁতার, হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে থাকি যাত্রায় কোনও গন্তব্য স্থির নেই,  তাই যেখানে বিশ্রাম, তা- গন্তব্য  'গভীর কালো আঁখি-তারাও গন্তব্য হয়ে ওঠে গন্তব্য আমার দিকে এগিয়ে আসে আমি তাকে ধারণ করি নতুন পথ দেখা দেয় 'আড়ালে কোথাও প্রচণ্ড বাজনা বেজে ওঠে....আর আমি কাগজের পর্বত ডিঙিয়ে ওপারে '------' পারেতে সর্ব সুখ' এই বিশ্বাসে
'ওপারে দিগন্ত অব্ধি জল আমি ওপারে ভেসে যাই  ভাসতে থাকি কবিতা লিখবো বলে  সমুদ্রকে নিয়ে কিছু লিখতে বাধ্য হই  আর ভাসি আর লিখি  বালুতটে বসি এসে লিখবো বলে ; 'সমুদ্রের জন্য গীতিকবিতা' 
উপচে পড়ি আমি ফেনায় ফেনায় জয়জয়কার করে চলনসই সমুদ্রের চালে আমি মাথা ঢোকালে সমুদ্র 'আমার মুখের মধ্যে সম্পূর্ণ ঢুকে পড়ে '  আমি তাকে নাক-মুখ দিয়ে নির্গত করি স্বস্তি পাই
লেখাশেষে আমি সমুদ্রখাতে এসে পড়ি আকাশের দিকে চেয়ে দেখি নীলরং নয়,  'অদ্ভুত লাল রঙের আলো'  দূরে চোখ যায় বালিতেও ডুবে যায় চোখ ভাঙাচোরা জিনিসের দিকে চোখ আমাকে টানে  আমি যতদেখি আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে  আয়ুস্কাল তার পিছু নিয়েছে যারা তারাও আমার দিকে ছুটে আসছে আমাকে ডাকছে আমি শুনতে পাচ্ছি না  আমাকে থামাতে চায় তারা 'মরচে পড়া এক ভোরবেলায়'
সাত সমুদ্র আর গুচ্ছ গুচ্ছ নদী পাহাড় আকাশ বাতাস পেরিয়ে  - এসে আমি যখন পৌঁছাই 'উপসংহার'- তখন দেখি---

'এরপর মৃত্যু বলবার কিছু নেই
আহ্বান বলবার কিছু নেই
মধু সাগর বলবার কিছু নেই
চোখে চোখ পড়লেই মূর্ছা বলবার কিছু নেই
যেকোনও স্রোতের জন্য অবগাহন বলবার কিছু নেই
যেখানেই থাকো পথ চেয়ে বসে থাকবো সারাজীবন--- তা- নেই

শুধু যেখানে পাতা পোড়াই
সেই দেহাত
শুধু যেখানে বালির ভেতর থেকে খুঁড়ে তুলি মৃত জনপদ
সেই তীর্থ
যেখানে মৃত্যুর জামাকাপড় শুকোতে দিই
সেই তীরভূমি
যেখানে সারাদিন ধরে ঘন্টা বাজাই
সেই কর্মস্থল
আমাদের সমস্ত মিলন যেখানে অসমাপ্ত ভস্ম সেই পৃথিবী 
সেই পৃথিবী
হাতের পাতায় রেখে বহুকষ্টে তুলে ধরা
সারাজীবনের সেই
                  মরুখণ্ড
   যেখানে
আর আমাদের দেখা হবে না...'
কারণ
'আজ আলোর পরের দিন, ধূলিকণার পরের দিন দুঃখের পরের দিন'....
মনের অন্তর্ভুক্ত  দৃঢ় বিশ্বাসে যে ভ্রমণ তা একমাত্র প্রাধান্য পায় মায়াবাস্তবের কল্পিত পরিসর আর বাস্তব একাকার হয়ে ঘুরে আসি আমি আর ফিরে আসি আর হারিয়ে যাই... 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে'          
  
                                                        

1 comment:

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম