১
সুদীর্ঘ আপেল
বাগানের পাশ দিয়ে ঢালু রাস্তা নেমে গেছে নীচে । দুপাশে শৈলশিরা,
পাহাড়শ্রেণির বুক চিরে সর্পিলাকারে বয়ে চলেছে বরফগলা নদী ।
নুড়িপাথরে ভরাট তার শরীর , মাঝেমধ্যে ব্রিজের নীচ দিয়ে
ক্ষীণ জলস্রোত পার হয়ে চলেছে বসতি । মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রে জমে থাকা সরোবর যখন
শৈত্যপ্রবাহে বরফে পরিণত হয় , তখনও এ নদী প্রবাহিত হয়
ধীরে, চারপাশে জমে থাকে বরফ । বরফের মধ্যে কোথাও কোথাও
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে চমরী গাই । শীতের সময়টা এখানে মূলত মধুচন্দ্রিমায় বেড়াতে আসে
নবদম্পতিরা । সারিবদ্ধ হোটেল ও শহরের মার্কেটে তখন রমরমিয়ে চলে শীতের পোশাকের
ব্যবসা । সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে এখানেই প্রকৃতি সবচেয়ে নিসর্গসুন্দর । পৃথিবীতে
যা কিছু স্তব্ধ যা কিছু সুন্দর , তাই-ই মর্মান্তিকভাবে
বিপদগ্রস্ত, বিধ্বস্ত । যাবতীয় সৌন্দর্যের উল্টোপিঠে বাসা
বাঁধে আতঙ্ক,—একথা স্বীকার না করলে হয়ত জীবনের সবচাইতে বড়
ভুল করা হবে । পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বেয়ে কখনো গড়িয়ে যায় জ্বলন্ত টায়ার, মোড়ে মোড়ে বসে যায় পুলিশ প্রিকেট , হঠাৎ
বিস্ফোরণে থমকে যায় সেনা কনভয়, কিংবা সেনা ছাউনি অথবা
ক্যাম্পে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে গুলির লড়াই । পরদিন সকালে নতুন সূর্যের আলোয় থমথমে
জনবসতিপূর্ণ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ থাকতে দেখা যায়, স্কুল-কলেজে
হঠাৎ ছুটি পড়ে যায় । সাংবাদিকদের আনাগোনা, সেনা টহল,মিটিং-মিছিল-জমায়েতে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে সেনাদের
মহড়া চলে সর্বত্র জুড়ে । প্রকৃতিপ্রদত্ত ভূস্বর্গের জনজীবন তখন অঘোষিত বন্ধের
চেহারা নেয় । যে পরিবেশ এতদিন ছিল ভ্রমণের, তার চেহারা
হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মতো । ভারতবর্ষের অন্যতম সৌন্দর্যের জায়গা এই
কাশ্মীরেই এসে কখনো লিখেছি একটানা হোটেলের ঘরে বন্দি হয়ে, কখনো-বা আপেলবাগানের ছায়ায় রাখা কাঠের গুড়ির ওপর বসে । কখনো ফুরিয়ে আসা
ম্লান রোদে হোটেলের বারান্দায় বসে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়েছি , সামনের পথ দিয়ে বন্দুকধারী সৈন্যদের টহল দেখতে দেখতে হাতে তুলে নিয়েছি
সদ্য ছুরিতে কাটা আপেলের টুকরো , কখনো-বা শীতের বরফ ঠেলে
সন্ধের অন্ধকারে গিয়েছি মদের খোঁজে , উষ্ণতা ফিরে পেতে ।
বারবার মনে হয়েছে ভালবাসার উপত্যকা কখনো কি ফিরে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে !
ব্যর্থ আমি ।
জীবনে কখনো কোনকিছুতেই সম্পূর্ণতা পাইনি । কোথাও ভ্রমণে গিয়েও পাইনি,
কারোর মধ্যে বেঁচে থেকেও পাইনি । আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে কখনো আয়োজন করে পরিকল্পনা করে ভ্রমণে যেতে পারিনি ।
ব্যস্ততার একঘেয়েমি থেকে দূরে থাকতে মানুষ যেমন ভ্রমণকে বেছে নেয়,
তেমনভাবে আমি কখনো কোন স্থানকে আমার নিজের জন্য বেছে নিতে পারিনি
। সেইজন্য আমার সঙ্গে প্রতিটি ভ্রমণের জায়গাতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে আমার ব্যক্তিগত
সম্পর্কগুলোর অশান্তি ও নব্যসম্বন্ধের প্রগলভতা । প্রকৃতি ও প্রেমের অন্তরঙ্গতার
মাঝে জন্ম নিয়েছি বলে তাদের অন্তরের বাতাসকে আমার বহুদিনের চেনা । যখনই কোথাও
বেড়াতে গিয়েছি,আমার সঙ্গে সহচর হয়ে যাত্রা করেছে আমার
ভালবাসার যন্ত্রণা, স্মৃতির তাড়না এবং কাগজ-কলম । আমাকে
লিখতে হয়েছে অচেনা প্রকৃতির শরীরে বসে , তার নৈঃশব্দকে
ছুঁয়ে । যাকে ভালবেসেছি, আমার অন্যায় হল এই যে— আমি আজও তার ভিতর থেকে উঠে আসতে পারিনি । সবুজ ঘাসের ঢালু জমিতে তাপহীন
রোদে গাছের ছায়ায় জনশূন্য লোহার বেঞ্চে বসে আমাকে লিখতেই হয়েছে ভালবাসার জন্য কিছু
লেখা । কখনো আমার যন্ত্রণাকে কেটেকুটে সমান মাপের ছন্দে গেঁথেছি, কখনো যা কিছু বলবার তা গদ্যেই প্রকাশ করেছি । নির্জন পাহাড়ি রাতে
কাঠকুটো জ্বেলে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে থেকে লিখেছি স্বীকারক্তি । সঙ্গী শুধু স্কচ
কিংবা হুইস্কি । আবার এমনও হয়েছে ,আমার জীবনে ফিরে এসেছে
আশ্চর্য সকাল । কফিতে ফুটন্ত দুধ ঢেলে লিখতে শুরু করেছি অবরোধের কথা, রক্তের কথা, মানুষের বন্দিদশা এবং দু’একটা চিঠি,—অন্তত সেই মেয়েটিকে যাকে আমি না
জানিয়ে মাঝেমধ্যেই চলে আসি এই নির্জনতার কাছে এবং প্রায় একইসঙ্গে তারও কাছাকাছি ।
আঙুরের থোকার মতো যার বুক, গালের আবিষ্ট ত্বক আপেলরঙের
মতো লজ্জায় দ্বিধায় মিশে এক হয়ে থাকে । আমি তাকে মনে মনে বসিয়ে দিই একটা সাদা
ঘোড়ার পিঠে । ঋজুলা শরীর আর বাতাসে এলোমেলো খোলাচুলে সেই মেয়েটি ঘোড়াটাকে নিয়ে
খানিকটা পথ বেড়িয়ে আসে । ততক্ষণ আমিও সেরে নিই আমার অসমাপ্ত লেখা । মেয়েটি ঘোড়া
সমেত গিয়ে দাঁড়ায় নদীর কিনারে । একটা
পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সে, আমি দেখতে পাই প্রকৃতির নিস্তরঙ্গ আভা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে মেয়েটির
শরীরের মধ্যে । জগতের সত্যকে খুঁজে পেতে আমাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেক বই । আমি
যখনই কোথাও গিয়েছি, ব্যাগের মধ্যে সারিবদ্ধ হয়ে আমার
সঙ্গে গিয়েছে বেশ কিছু বই । চিরকাল পালিয়ে বেড়িয়েছি, অনন্ত
সমুদ্র থেকে অপার শৈলশিরায় আশ্রয় নিয়েছি , খেয়েছি নানা
স্থানের উনুনে স্যাঁকা রুটি , বিভিন্নশ্রেণির মদ, অনেক পশুর মাংস, সামুদ্রিক মাছ, ভিন্ন প্রজাতির ফল ও সব্জি , তবু কখনো এই বদলে
যাওয়া আবহাওয়ার কাছে সমর্পণ করিনি নিজেকে । কেননা,
আমার বৃত্তি আমি নিজে বেছে নিইনি । আজ এতকাল পরে মনে হয়,জীবনের কাছে একমাত্র অপরাধী শুধু একজন লেখকই হতে পারে । আমি শুধু হতে
পেরেছি একজন অভিজ্ঞ লেখক, বিবরণ বা বর্ণনা কোনটাই লিখতে
পারিনি আমি । কারণ, অন্য অনেককিছু নিয়ে আমার লেখার ছিল ।
তাই আদ্যপ্রান্ত বিবরণের মধ্যে না গিয়ে আমি শুধু লিখেছি সেইসব কথা , যা চিরদিনই উপেক্ষিত হয়ে আছে ।
সব মানুষই সমান,
একই যন্ত্রণার মুখাপেক্ষী । নতুন করে কিছুই বলার নেই । জীবনে এক
একবার আমাকে বাস করেতে হয়েছে গিরিশৃঙ্গের চূড়ায় এবং খাদের অতলে । কিন্তু ভ্রমণের
অভিজ্ঞতায় আমার তেমন দুর্দশা কখনোই ছিল না যার মধ্যে আমি আমার বিচারবুদ্ধি হারিয়ে
বসব । শ্রীনগর বিমানবন্দরে নেমে মনে হয়েছিল, যেন এসেছি
প্রকৃতির আরাধ্যে, প্রেমের জারণে,এসেছি খিদের জগতে, অধিকার ও শ্রেণিসংগ্রামের
লড়াইয়ের মাঝে । এসেছি ফুলের রাজ্যে, স্যাফ্রনসিটি কিংবা
রাষ্ট্ররাজনীতির উদ্বিগ্ন এলাকায় ।
কাশ্মীরের
তুষারাবৃত পরিবেশে যতদিন ছিলাম, বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছি তুষারচাপা পাহাড়ের শোভা এবং একইসঙ্গে
কাশ্মীরিদের জীবনযাত্রা । হোটেলের বারান্দায় জমে থাকত বরফ, রেলিংয়ের লোহাগুলো বরফে নিজেদের শরীরের অর্ধাংশ ডুবিয়ে রাখত ।
বৃক্ষশাখায় পুঞ্জীভূত হয়ে জমে থাকত বিগত রাতের তুষারপাতের চিহ্ন । ঘোড়াগুলো
স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করত বরফের ওপর দিয়ে । সেনারা বরফ কেটে রাস্তা উদ্ধারের চেষ্টা
করত । এ সময় কাশ্মীরিদের দোকান বাজার বন্ধ থাকত, শীতের
সময়ে তারা আগে থাকতে খাদ্য মজুত করে রাখে ঘরে । কিন্তু আমার অনভ্যস্ত দৃষ্টি এই
নির্জনতার মধ্যেও খুঁজে পেত বেঁচে থাকার গতিপথ । হয়ত বেরিয়ে পড়লাম আর এক বোতল
হুইস্কির খোঁজে , দেখতে পেলাম আপেল বাগানের পাতাঝরা
গাছগুলির নীচে বাঁধা রয়েছে একটা কালোঘোড়া । যার তরুণ মালিকটির গালভরা দাড়ির ওপর
রাখা রয়েছে একটি নির্ভরযোগ্য সরু আঙুলের রমণীয় করতল । আর একটু এগতেই নজরে আসত সেই
যুগলবন্দি মানুষ দুটো । তুষারপাতের মধ্যেও যারা লুকিয়ে দেখা করতে এসেছে পরস্পরের
সঙ্গে । কিংবা সেনা ছাউনির ক্যাম্প থেকে দূরে একটা চায়ের দোকানে জনাকয়েক কাশ্মীরি
মানুষের জমায়েত যারা সেনা অপসারণের দাবিতে ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছে । রাস্তার ওপর সেনা
কনভয়ের জন্য মাঝে মধ্যে থামতে হত । তারপর রাস্তা ডিঙিয়ে ঢুকে পড়তাম সরাইখানায় ।
কাশ্মীরি মহিলারা সেইসব সরাইখানা পরিচালনা করে , কেননা
পুরুষেরা বেশিরভাগই ঘোড়া নিয়ে নীচের শহরে গিয়েছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে ।
কারোর-বা শ্রীনগরের মার্কেটে শীতবস্ত্রের দোকান রয়েছে । কাঠের টেবিলে খুলে রাখতাম
টুপি । টুপি খুলতেই ঝরে পড়ত টুপিতে জমে থাকা বরফকুচি । সুরাপান ও লেখা আমার
বহুদিনের সঙ্গী , আজ মনে হয় পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন,
লেখা ও মদ্যপানের বদঅভ্যাস আমার সঙ্গে সঙ্গেই যাবে । এমনও হয়েছে ,পাথরের ওপর জমে থাকা বরফ ঠেলে ফেলে দিয়ে বসে পড়েছি । হাতের দস্তানা
খুলে বের করেছি কলম ও লেখার খাতাটা । ছড়ানো যন্ত্রণা থাকে মানুষের । আমি সেসব
যন্ত্রণাকে ভাষার আকার না দিয়ে থাকতে পারি না । লম্বা ওভারকোটের পকেটে বোতলবন্দি
মদ একটু একটু করে খেয়েছি । দেখেছি পাহাড়ি একটা বাজপাখি আকাশে চিৎকার করতে করতে
উড়ছে, সেই তুমুল তুষারপাতের মধ্যেও তার খিদের সন্ধান চলছে
। খাদ্য আর আশ্রয়ের অনস্বীকার্য সংকটকে ব্যতি রেখে মানুষের জীবনে আরও খানিকটা
পর্যায় পড়ে থাকে । সেটা হয়ত প্রেম, কিংবা আত্মসম্মান
বাঁচানোর তাগিদ । প্যাহেলগাঁওতে একবার এক কাশ্মীরি লোকের কাছে শুনেছিলাম তার
শিশুপুত্রকে গোপনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আততায়ীরা । যার শরীরের বেঁধে দেওয়া হয়েছিল
আরডিএক্স , কিন্তু সময়মতো বিস্ফোরণের আগেই শিশুটি ধরা
পড়ে যায় আর্মিদের হাতে । উপত্যকার নদী, বরফ,মাটি, গাছপালা এবং আকাশ এতকাল যাদের ছিল,
তারা হয়ে দাঁড়াল রাষ্ট্রের চোখে ব্রাত্য । সৌন্দর্য গিয়ে পড়ল
লুঠতরাজের দখলে । কাশ্মীরে রক্ত আর অধিকাররক্ষার কাহিনি ছাড়া কিছুুই প্রায় লেখা
গেল না । খানিকটা স্যাফ্রন , কিছু আপেল ও একটা কালো শাল
ছাড়া প্রায় কিছুই সেখান থেকে আনতে পারিনি আমি । কেননা, পাহাড়প্রদেশে
বসে লেখা সমস্ত কবিতাই অগ্রন্থিত রয়ে গেছে ।
২
প্রেম মানে কি
মিসিং ? বৃহৎ ও চিরস্থায়ী সম্পর্ক কি চিরদিনই
চাপা পড়ে থাকে হারিয়ে ফেলা সম্পর্কের কাছে ? হাত ছেড়ে দেয়
হাত, চলে যায় অন্য হাতের দখলে । কিন্তু দৃষ্টি ? দৃষ্টি তো শূন্যতার মধ্যে স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে ফেরে । অন্তত
নীলসমুদ্রের কাছে আমি যতবার একা গিয়েছি, দেখেছি আমি ততটা
একা নই, আমার একাকীত্বে হাত পড়েছে অন্য আরেক মানুষের ।
তার ঠোঁটে লজ্জা, সাহস হারিয়ে নিজেকে কোনমতে সামলে সেই
মেয়ে চিরদিন অপেক্ষা করেছে যাতে কেউ অন্তত এসে তার নৈঃশব্দকে স্পর্শ করুক ।
দ্বীপের সমুদ্রসৈকতে মূল ভূখণ্ডের মতো এত স্রোত নেই । এখানে ডুবন্ত জল সম্মুখে ঈষৎ
নীল, দূরে সবুজ । বালির সৈকত যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু প্রবালের রাজ্য , আছে রঙিন
মাছের ঝাঁক , আছে সীগালের আনাগোনা,—নির্জন দ্বীপে এরাই আদি বাসিন্দা । পর্বতের তুষারাবৃত পরিবেশে শরীর
সর্বদা প্রার্থনা করে শীতপোশাকের উষ্ণতা, কাঠের আগুন,
নরম লেপের অভ্যন্তরে একটুকরো নির্জনাবাস, যেখানে বই হয়ে ওঠে সুদীর্ঘ রাতের প্রিয়তম সঙ্গী । ভালবাসা সেখানে
চিরকাল পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ বরফের মতো একা । কিন্তু সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় ভালবাসার
স্বাদ সর্বদা পুরনো মদের চেয়েও গাঢ় । প্রেম এখানে ঝেড়ে ফ্যালে সংস্কারের যত
পরিত্যক্ত পোশাক । প্রেম এখানে উচাটন, যেন তার ভিজে শরীরে
লেগে আছে নোনাবালি, বহুজন্মের আন্তরিক দুঃখের মতো,
সম্পর্কের সীমা ভেঙে একটুকরো অবৈধতার স্পর্শ, যা শরীরের জল শুকিয়ে গেলে নীরবে ঝরে পড়বে, তোমাকে
জানতেও দেবে না । একবার ভার্জিনিয়া উলফ্-এর ‘টু দ্য
লাইটহাউস’ সঙ্গে নিয়ে বসেছিলাম হ্যাভলক আইল্যণ্ডের সমুদ্রসৈকত
লাগোয়া বারে । মদ্যপানের সঙ্গে শরীরে ট্যাটু বানিয়ে নিচ্ছে বেশকিছু বিদেশি
যুবক-যুবতী । পাশাপাশি দুটি গাছের মধ্যে বাঁধা হয়েছে কাপড়ের দোলনা । টানানো সেই
দোলনায় কেউ কেউ শুয়ে বই পড়ছে । যতদূরই চোখ যায় অবাধ জলরাশি, মাঝেমধ্যে মাছধরা ট্রলার ও যাত্রীবাহী জাহাজ নজরে আসে আবার সময়ান্তরে
তা মিলিয়ে যায় দৃষ্টি থেকে । সেইসব দৃশ্যের যা কিছু ব্যাথাবেদনা , সেসব আমি বন্দি করেছি লেখায় । আবার সঙ্গে করে যে সমস্ত বই আমি নিয়ে
বেড়িয়েছি, যেগুলো প্রায় প্রতিটি দৃশ্যের কাছে পলায়ন করেছে
আমাকে, সেসব বইয়ের ক্রাইসিসকে আমি পৃষ্ঠার কয়েদিজীবন থেকে
মুক্তি দিয়েছি । আমার ভালো লেগেছে হারিয়ে থাকতে, সুদূর
ভ্রমণে একা হতে, অন্তত তার কাছ থেকে যাকে আমি ভালবেসেছি ।
অন্বেষণ মানুষকে নিয়ে যায় সত্যের কাছাকাছি , ভ্রমণ সেই
অন্বেষণের আগুনে যোগান দেয় ব্যক্তিগত প্রেমের বারুদ । পুড়ে নষ্ট হওয়া যাওয়া জীবন
থেকে আমরা মানুষেরা যখন পালাচ্ছি, স্যুটকেস হাতে টুপি পরে
,রোদচশমার আড়ালে নিজেদের বিনষ্ট লোভাতুর চোখ ঢেকে আমরা
যখন জাহাজে উঠছি , তখন সেই মুহূর্তে লাউটহাউসের দিকে নজর
পড়তেই আমরা কি দেখতে পাই না আমাদের হারিয়ে ফেলা বাসনাগুলো ? বাংলা সাহিত্যে আমি যেকটা ভ্রমণের বই পড়েছি তার মধ্যে বেশিরভাগই
ভ্রমণপথের বর্ণনা, কিংবা অচেনা স্থানের মানুষদের
জীবনযাত্রা, দারিদ্র বা গরিবিয়ানা নিয়ে লেখা । চাষ-আবাদ
বা শিল্প নিয়ে লেখা বই যে পড়িনি তা নয়, পড়েছি সামাজিক
জনজীবন নিয়ে লেখা বইও । তবে ভ্রমণের বিবরণকে বাঙালি লেখকরা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছে
নিজেদের উপন্যাসে । সেখানে প্রকৃতিকে মিলিয়েছে উপন্যাসের নারীচরিত্র এবং প্লটগুলোর
সঙ্গে । বিদেশি সাহিত্য কিন্তু এখানে উল্টোদিক থেকে তুলে ধরেছে মানুষকে । দৃশ্যের
সঙ্গে সেসব সাহিত্যে পাল্টে যাচ্ছে ভালবাসার দিক । সম্পর্ক ভাঙছে, জীবনে আসছে নতুন পুরুষ বা নতুন নারী । কিন্তু আগের পুরুষ বা নারীটিও
থেকে যাচ্ছে গণনাহীন যন্ত্রণা আর দূরত্বের সঙ্গী হয়ে । মানুষের সঙ্গে মানুষের আলাপ,
ব্যক্তিযোগ, মেলামেশা, বন্ধুত্ব বা ভালবাসা,—কোনটিই যে ভুলে যাওয়া বা
মুছে যাওয়ার নয়, তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ‘ভ্রমণ’ । সে ভ্রমণ পরিবারের সঙ্গেই হোক বা
একাকীই হোক , কিংবা প্রিয় মানুষের সঙ্গেই হোক বা তাকে
হারিয়ে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হয়েই হোক, সে ভ্রমণ উপন্যাসেই
লেখা হোক বা প্রবন্ধেই ছাপা হোক, সমস্ত বেড়িয়ে বেড়ানোর
কাহিনি আসলে মানুষেরই বেঁচে থাকার গল্প । আমি বহুবারই মরেছি স্থান বদলের নেশায়,
কখনো আন্দামানের নীলাতল সমুদ্রে, কখনো
বরফাবৃত কাশ্মীরের পাহাড়ে, আবার
কখনো বনভূমির সৃজনে, কিন্তু ভ্রমণ আমাকে কোনদিন মরতে
দেয়নি । তবু আমি বারবার মরেছি, মরেছি হতাশ হয়ে, মরেছি নিজেকে খুঁজতে গিয়ে । প্রতিবার আমার মনে হয়েছে এই পাহাড়ি শহরেই
হয়ত কোন একটা চার্চে নান্ সেজে রয়েছে আমার ভালবাসার নারীটি । নিগূঢ় শরীরে আজন্ম
উন্মাদিনী সে, তবু লজ্জার বেড়া ভাঙতে না পারায় তাকে বেছে
নিতে হয়েছে ঐ খ্রিস্টীয় পোশাক । আবার স্নিগ্ধ পূর্ণিমার আলোতে যখন বসে থেকেছি
নির্জন সমুদ্রের সৈকতে , আমি তখন দেখতে পেয়েছি সেই
আলোবর্তিনীকে, যার সর্বাঙ্গসুন্দর নমনীয় মন শুধুমাত্র
পুরুষে উৎসর্গ । বহুবার লিখেছি তাকে, একমাত্র সেই আমার
ভ্রমণযোগ্য হয়ে উঠেছে এতগুলো বছরে । মাঝেমধ্যে দু’একটি
চিঠি আমি তার থেকেও পাই । ভ্রমণ কি শুধু শরীরের ? স্থানান্তরের
? বইয়ের মধ্যে দিয়ে , চিঠি লেখার
মধ্যে দিয়ে কতবার আমি বেড়াতে গিয়েছি সেই মেয়ের সঙ্গে, আমরা
বৃষ্টিভেজা ঘাসের জমিতে পা ফেলে শুরু করেছিলাম বন্ধুত্ব, সেসব
সম্পর্কের ব্যক্তিগত দলিল কি আমাদের জীবনের ভ্রমণ নয় ?
৩
কেন আমি তাকে
বারবার লিখেছি ‘নির্জনতার কাছে শুধুমাত্র একজন লেখকই
হতে পারে সমস্ত জীবনভর অপরাধী ?’ দু’একদিন হাতের বাদবাকি লেখা সরিয়ে রেখে চিঠি লিখেছি সেই মেয়েকে, জানিয়েছি মানুষ কখনো ভ্রমণে একা যেতে পারে না । মানুষ সর্বদা সমস্ত
ভ্রমণে তার নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে যায় আস্ত আরেকটা মানুষ । সেই চিঠি পাওয়ামাত্র
অন্য আর পাঁচটা লেখা কিংবা সদ্য পড়তে বসা উপন্যাস ফেলে রেখে সেই রমণী আমাকে ফেরত
চিঠিতে জানিয়েছে আমার ভাবনার যৎসামান্য ভুলের কথা,—‘মানুষ
নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলে আরও অনেক মানুষ কিন্তু সঙ্গ তাকে শুধু দু-একজনই দিতে
পারে, তারচেয়ে বেশি কেউ নয় !’ কোথাও
রওনা দেওয়ার আগেরদিন আমি ছুটি নিই আমার কর্মস্থান থেকে,আত্মীয়তা
থেকে, সম্পর্কগুলোর থেকেও আমার বিরতি অব্যাহত থাকে ।
টুকরোটাকারা জিনিসের সঙ্গে বই বাছাই চলে সেই দিনটায় । কেমন কবিতা চাই হিমালয়ের
বুকে ঝর্ণার ধারে বসে বসে পড়ার জন্য , কোন্ উপন্যাসটা পড়া
শুরু করতে চাইছি পাহাড়ি ভোরের সামান্য আগে থেকে, বইয়ের
আকার, পুরুত্ব এমন হওয়া চাই যা আমার হ্যাণ্ডব্যাগের মধ্যে
সহজেই ঢুকে যাবে । কেননা, বিমানে ঐ হ্যাণ্ডব্যাগটাই
অ্যালাউ করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য । ভ্রমণের যাত্রাপথে বই পড়া হল নিজেকে
দূরত্বের সঙ্গে একরকম করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা । কতদূর সফল হয়েছি সেই চেষ্টায়
, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে বাকি থাকা এই অন্তহীন জীবন ।
শুরুটা করেছিলাম
প্রবন্ধ লিখব বলে , যে লেখার মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে ‘ভ্রমণ’ । কিন্তু বদলে ফেললাম বিষয়ের
অভ্যন্তরীণ আলোকপাত । ব্যক্তিগত সত্যগুলো ছাড়া কোন লেখাই আমি নিয়ে যেতে পারি না
প্রান্ত পর্যন্ত । সুতরাং , বদলে যায় প্রবন্ধের শরীর,
উপন্যাসের আকার, কবিতার স্বরূপ । বিষয়
সরে আসে বিষয়ান্তরে । ‘ভ্রমণ’ তো
অবিচ্ছেদ্য নয় । তার সঙ্গে জুড়ে থাকে নৈকট্য,দূরত্ব,
নির্জনাবাস, অস্তিত্বের সন্ধান, সম্পর্কের মায়া, সরে থাকার আত্মসম্মান ,
ভুলে থাকার বিরাম,পালিয়ে বাঁচা, আড়ালে চলে যাওয়ার মতো মর্মান্তিক পরিণাম ইত্যাদি । এদের সকলের সঙ্গেই
আমার বহুবার পরিচয় ঘটেছে বহু জায়গায় ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে । বিষয়ে ফিরে আসার জন্য
আমায় নিজেকে ভাঙতেই হয় । আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক লেখকই
তাই করেন , কিন্তু লিখিত কুণ্ঠা অলিখিত লজ্জাকে প্রকাশ
করতে বাধা দান করে বলেই লেখকের ব্যক্তিযন্ত্রণা ভ্রমণের প্রকৃতিতে খুঁজে নেয়
নিজস্ব স্বাধীনতা । দ্বিধাহীনভাবে সেখানেই আমি খুঁজে পাই নিজের অপরাধের গুরুত্ব ।
বিষয়ে ফিরে আসতে অনেকটা লেখা আমাকে খরচ করতে হয় , ঠিক
যেমন ভ্রমণের সমস্তটুকু আমি লিখতে পারলাম না এখানে । সেইসব চন্দ্রাহত রাত, যেখানে দৃশ্যে ছড়ানো প্রিয়তমা রমণীটির শরীরসৌরভ । সাদা বাতিস্তম্ভের
আলোতে যে নারী তৈরি করতে পারে অস্ফুট আকর্ষণের ছায়া , চিরজীবন
তার পিছনে ছুটে চলাকে কি আমার পুরুষজীবনের ভ্রমণ বলা যায় ? জানি না ! কিন্তু
যতদিন বাঁচতে থাকা আছে, আছে আরও লিখতে পারার প্রয়োজন,
আছে সমস্ত আর্তি তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যাতে ধরা না পড়ি,
আছে পলায়ন, আছে পুনরায় প্রমাণ নিজেকে
প্রমাণ করতে পারা যে,‘হ্যাঁ—ভুল
আমার মধ্যেও ছিল, কিংবা আমি সবটা জায়গা জুড়ে অবহেলা করিনি’
, ততদিন ‘ভ্রমণ’ শব্দটা লেখার পাতায় থেকে যাবে ‘যাপন’ শব্দটার পাশাপাশি । দ্য ওয়ানস্ উইল নেভার ডাই উইথআউট অ্যানাদার ওয়ানস্
!
No comments:
Post a Comment