দুপুর
একটা বেজে গেল। খিদে পাচ্ছে। রাস্তার ওপরেই ধাবার খোঁজ শুরু হল। খানিক দূর গিয়েই
অজয় গাড়ি দাঁড় করাল। এখানকার খাসির মাংস বিখ্যাত। খাসির মাংস সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন
সারা হল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। গন্তব্যে পৌঁছতে
সন্ধ্যা হয়ে যাবে। মোতিহারি পৌঁছতেই তো এগারোটা বেজে গেল। এখন গান্ধী সেতুতে
যা জ্যাম! সেই সকাল আটটায় বেরিয়েছি পাটনা থেকে। মাঝে
অবশ্য, মুজাফ্ফরপুরের আগেই, সাহু মিষ্টান্ন ভান্ডারে চায়ের বিরতি নেওয়া
হয়েছিল। মোতিহারিতে কাজ সেরে পৌঁছতে হবে বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।
মোতিহারি ঢোকার আগে হাইওয়েতেই বড় বড় অক্ষরে লেখা দেখেছি- George Orwell
Birthplace. কার্যত আমার বায়নাতেই
অজয় গাড়ি ঘুরিয়েছিল অরওয়েলের জন্মস্থানের দিকে। অনেক ঘোরাঘুরি করেও, দুর্ভাগ্য, খুঁজে
পাওয়া গেল না। এবার মনে হল মোতিহারিতে এলাম আর চম্পারণ সত্যাগ্রহর জায়গাটা
একবার দেখব না? পৌঁছে গেলাম গান্ধীজি যেখান থেকে
নীল চাষীদের জন্য চম্পারণ সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন একশ বছর আগে, সেই ভিটিহরয়া গ্রামে। বিশাল মাঠ, একপ্রান্তে খোলা মঞ্চ। নিরিবিলি জায়গা, যেন
ইতিহাস এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। চম্পারণ সত্যাগ্রহ কি শতবর্ষের ইতিহাস বহন করে ক্লান্ত,
নিঃসঙ্গ? এখনও কি প্রাসঙ্গিক? যাই হোক সে অন্য প্রশ্ন ।
ঘুরতে যেতে ভালই লাগে। আমার
অবশ্য আগেভাগে প্ল্যান করতে ভাল লাগে না। হঠাৎ মনে হল ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। এখন পেশাগত
কারণে ভালই ঘোরা হয়। এ্যাকাডেমিক পরিভাষায় যাকে বলে Field Visit. এবারের বেরোন সেই কারণেই, সঙ্গে আমার
সহকর্মী ড. রাজীব কমল (সামাজিক নৃবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক) আর গাড়ির চালক অজয়। সুন্দর
ঝকঝকে রাস্তা। সেই সকালে বেরোলেও কোন ধকল অনুভব হচ্ছিল না। অজয় চালিয়েছে গান,
বিচিত্র সব গান। কখনো কুমার শানু, কখনো কিশোর, কখন-ও বা ভোজপুরি গান। আমার পেন
ড্রাইভ দিলাম। সেখানেও বিচত্র সব সংগ্রহ। হিন্দি, বাংলা ইংরেজি। ভালোই বুঝতে পারলাম
অজয়ের ভালো লাগছে না। সুমনের ‘তোমাকে চাই’ শুরু হলে রাজীব আর অজয়কে আপ্রাণ বোঝানোর
চেষ্টা করলাম এই গান পশ্চিম বাংলাতে কেমন আলোড়ন ফেলেছিল। যাইহোক মিলিয়ে মিশিয়ে সব
গান শুনলাম আর বাইরের অপূর্ব পরিবেশ মন ভরিয়ে দিল। কত অজানা গাছ, পাখি! কখনো মেঘ
আবার পরক্ষণেই পরিষ্কার আকাশ।
পৌঁছতে
সেই সন্ধ্যায় হল। এইসময় আর কাজ হবে না। জায়গাটা বিহার আর উত্তর
প্রদেশের বর্ডার। সেরকম কোন হোটেল পাওয়া গেল না। এখানকার নাম
তুমকুহিরাজ, উত্তর প্রদেশের একটি জনপদ, কুশিনগর জেলাতে। এখান থেকে কুশিনগর শহরের
দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারের মত। এই সেই কুশিনগর যেখানে গৌতম বুদ্ধ
সমাধিস্থ হয়েছিলেন। রাজীবের উপস্থিত বুদ্ধি
কাজে লাগিয়ে এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে উত্তর প্রদেশ সরকারের গেঁদা সিং গন্না শোধ সংস্থানে (আখ বিষয়ে গবেষণা হয়)। হাজির হলাম। সংস্থানের ভারপ্রাপ্ত
নির্দেশক সাথে সাথে অতিথিশালাতে একটি রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন। এসি র ও বন্দোবস্ত
আছে। এত গরম। এখানে আবার দিনে ১৪/১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে।
রাত এগারটা পর্যন্ত জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে। একবার কারেন্ট আসে আর যায়। বার বার সুইচ বদলাতে হয়। সারাদিনে দু’বার জল আসে।
ফ্রেশ
হয়ে রাতের খাবার সন্ধানে বেরোন হল। পৌঁছালাম তুমকুহিরাজ বাজারে। এখানেও মানুষের মাংসের
প্রতি প্রীতি চোখে পড়ার মত। সারা বাজার জুড়ে ছড়ানো ঠেলা গাড়ী আর তাতে তৈরি হচ্ছে
মুরগী আর খাসির মাংসের নানান পদ। কত বিচিত্র তার নাম- ছড়ি কাবাব, কলিজা ফ্রাই,
বোটি কাবাব। দোকানগুলোতে ভিড়ও ভালোই হয়েছে।
সকালে
উঠে পুরো ক্যাম্পাস দেখার সুযোগ হল। প্রায় ৩০০ একর জায়গা জুড়ে ছড়ানো বিশাল ক্যাম্পাস।
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। এর বাইরেও ৭০০ একর জমিতে পরীক্ষামূলক
চাষের ব্যবস্থা আছে। এতবড় ক্যাম্পাসে দেখভাল করার লোক নামমাত্র। খবর নিয়ে জানা গেল দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ। গবেষক/কৃষিবিজ্ঞানীর পদের
সংখ্যাও হাতে গোনা।
সকালে ‘নাস্তা’ করে পৌঁছলাম
মোতিপুর গ্রামে; ঠক্রহার ব্লক, পশ্চিম চম্পারণ জেলা। প্রথম যখন এই গ্রামে পৌঁছলাম
মনে হল যেন কোন দ্বীপে পৌঁছেছি। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। বিশ্বায়ন যেন এই গ্রামে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের উত্তরে বয়ে গেছে গণ্ডক নদী। এই নদী বিহারে ‘সদা
নীড়” নামে পরিচিত। অবশ্য বর্ষায় ভালোয় দুঃখ ডেকে
আনে। গন্ডক পেরোলেই পশ্চিম চম্পারণ জেলার সদর শহর বেতিয়া; তারপরেই নেপাল। এই গ্রাম
থেকে বেতিয়া পৌঁছতে দু’ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। এ-এক বড় সমস্যা গ্রামবাসীদের। গ্রামের
বাকি তিন দিক উত্তরপ্রদেশ। তুমকুহিরাজ থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার। বিহারের গ্রাম, কিন্তু প্রায় সব লেন-দেন প্রায় উত্তর প্রদেশের
সাথে।
মোতিপুর গ্রামে স্বাধীনতার
সত্তর বছর পরে ইলেক্ট্রিকের পোল পড়ল। গড়ে উঠেছে পাওয়ার গ্রিড, গ্রামবাসীদের দেওয়া
জমিতেই। সেই বিষয়েই সামাজিক প্রভাব
মূল্যায়ন করতে আসা। সাড়ে চারশ পরিবারের বাস এই গ্রামে। সুন্দর গ্রাম, সবুজে ভরা।
আর আখের ক্ষেত। আখ এখানকার প্রধান ফসল। পুকুর ছাড়াও ছোট ছোট জলাশয় আর জলাশয়ের পাড়ে
পাড়ে অসংখ্য ছোট ছোট মন্দির, তিন-চার ফুট উচ্চতার।
আমরা একটা চালার নীচে গিয়ে
বসলাম। আমাদের সাথে আজ যোগ দিয়ে রিসার্চ টিমের বাকি সদস্যরা। চালার নীচে রাখা আছে একটা
খাটিয়া। আমরা আসাতে বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার এল। চালাটি এই গ্রামের মুখিয়া,
(প্রধান) সুরিন্দার
কুমারের। মুখিয়া মানুষটি বেশ। খোলামেলা। দেখে তো মনে হল ভালই জনপ্রিয়। এই
চালাটিকেই তিনি একপ্রকার অফিস বানিয়ে নিয়েছেন। গ্রাম থেকে পঞ্চায়েত অফিস বেশ খানিকটা
দূর হওয়াতে গ্রামের মানুষের বেশ সুবিধায় হয়েছে, বিশেষ করে বিভিন্ন সার্টিফিকেট সংগ্রহ
করতে। পোল থেকে তার টেনে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন আবার বাড়ি থেকে টেবিল
ফ্যান নিয়ে এসে প্ল্যাগে গুঁজে দিল। এরমধ্যেই অনেকে এসে হাজির হয়েছেন। শুরু হল আলোচনা।
মূল আলোচনা তো আছেই, সঙ্গে গ্রামের নানান বিষয়। আমার হিন্দি শুনেই মুখিয়াজী জিজ্ঞাসা
করলেন পশ্চিম বাংলাতে কোথায় বাড়ি। তবে একটা কথা বলতে পারি, উচ্চারণের পার্থক্য থাকলেও
অনেক বাংলা-হিন্দি শব্দ এক। এরপর চা-জল-বিস্কুট চলে এলো।
এই গ্রামে প্রায় সব বাড়ি থেকে
অন্তত একজন রাজ্যের বাইরে কাজ করতে গেছে। প্রথম ইলেক্ট্রিক আসাতে গ্রামের সবাই খুব
খুশি। গ্রামের দু’এক বাড়িতে টিভি এসেছে। খবরের কাগজ আসে না কোন বাড়িতে। মাঝে মাঝে
কেউ হয়তো তুমকুহি বাজারে গেল আর খবরের কাগজ নিয়ে এল। তবে অনেকের হাতেই এখন স্মার্ট
মোবাইল। বেশিরভাগ বাড়িতেই শৌচালয় নেই। এখন অবশ্য সরকারি নজরদারি বেড়েছে। বাড়িতে বাড়িতে
শৌচালয় ও তৈরি হচ্ছে। বাড়িতে শৌচালয় না থাকায় সবথেকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়
গ্রামের মহিলাদের। সব থেকে বিস্ময়কর ও আতঙ্কের, সরকারি
নজরদারির ভয়ে মহিলারা ঘর থেকে ‘লোটা’ নিয়ে যেতে পারে না। মাঠ থেকে ফিরে বাড়ীতে জলের
ব্যবহার করে। বর্ষাতে গ্রামের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে ওঠে। গ্রামের
বেশিরভাগই জলের তলায় চলে যায়। তখন স্কুল বন্ধ। প্রকৃত অর্থেই গ্রাম তখন স্থবির হয়ে
যায়। তবে গ্রামের মহিলারা বিহারে মদ নিষিদ্ধ হওয়াতে খুশি।
তবু ওঁরা সাবধানে থাকে, দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যেই যে উত্তর প্রদেশ।
গ্রামে যাদব পরিবারের সংখ্যায়
বেশি। আপাত দৃষ্টিতে সেইভাবে জাতিভেদ প্রথা নেই। মোতিপুর। কিন্তু এই প্রথার চোরাস্রোত বয়েই চলেছে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার
নিদর্শন, কম হলেও, যযমানি ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান।
অর্থনীতির মধ্যেও, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনিময় প্রথাও কিছুটা রয়ে গেছে। কথা বলে বোঝা গেল ভিন্ন
জাতির মধ্যে বিয়ে এই গ্রামে হয় না। মুখিয়াজী আলাদা, আড়ালে জিজ্ঞেস করলাম, এই
গ্রামে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করে না। প্রেম বিবাহ হয় না? উনি স্পষ্ট জানালেন- দেহাতে
এসব হয় না।
হঠাৎ কানে এল চিৎকার। সবাই ছুটে
গেলাম। প্রায় ত্রিশজন মহিলা- পুরুষের ‘কাঁওয়ারি’ পার্টি চলেছে ‘ভোলে বাবা’র মাথায়
জল ঢালতে। আর পুরো গ্রাম তাঁদেরকে বিদায় জানাতে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল পুরো
গ্রামবাসী এক হয়ে দূর্গাপুজো করে। ছটের আগে-আগেই দূর্গাপুজোতে সারাগ্রাম মেতে ওঠে।
বিহারের অনেক গ্রাম ঘুরেছি। আতিথেয়তায় বা আপন করে নেওয়াতে বাংলা বা বিহারের গ্রামের
কোন পার্থক্য নেই। হয়তো পৃথিবীর সব গ্রাম-ই এক এই বিষয়ে।
যখন উঠব উঠব করছি মুখিয়াজী কিছুতেই ছাড়বে না। খেয়ে যেতেই
হবে। বাকি গ্রামবাসীদেরও একই আবদার। না করা গেল না। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এল চূড়া-দহি
(চিড়ে ও দই)। ঘরের তৈরি, সঙ্গে আখের গুড়। খাওয়া শেষ হলে ঘটিতে করে জল নিয়ে হাত ধোওয়ার
সময় লক্ষ্য করলাম নিমগাছের তলায় একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সব অবাক দৃষ্টিতে
দেখছিলেন। কোলে আনুমানিক একবছরের বাচ্চা, ডানহাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর তিনেকের বাচ্চা।
মহিলার বয়স উনিশ, বড়জোর কুড়ি। কিন্তু এই বয়সেই পাকা গিন্নি। মনে মনে ভাবলাম এর স্বামীও
হয়ত ভিন রাজ্যে কাজ করতে গেছেন। হয়ত ছট বা হোলিতে বাড়ী ফিরবে। তাঁর মন স্বামীর
অপেক্ষায়? কী জানি। সেটাই তো স্বাভাবিক।
এবার বেরোতে হবে, এই দ্বীপখন্ড
থেকে।
গতকাল সাক্ষাৎ হয়েছিল
ইতিহাসের সাথে। আজ দেখলাম এক আশ্চর্য ভৌগলিক পরিবেশ। এমন কিছু ভ্রমণ শুধু মনকে আনন্দ
দেয় না, পেশাগত কর্তব্য পালন তো করতেই হয়, এরই সাথে ইতিহাস-ভূগোলকে এক করে দেয়। তখন
আর তা নিছক ভ্রমণ থাকে না।
লেখার মধ্যে সহজ সারল্য খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে।কোন দেখনদারি নেই। বেশ ভালো লাগলো।
ReplyDelete