প্রথম
যেদিন ঠিক হলো নেপাল যাওয়া হবে এবং পশুপতি নাথ দর্শন করা হবে, সেদিনই প্রায় জনা
ছয়েক রাজি হলাম। যথারীতি প্রস্তুতির শুরু। রেল টিকিট, বাস এর খোঁজ ইত্যাদি হতে হতে
আরো পাঁচ জন যোগ হয়ে গিয়ে আমরা হলাম 11 আর্মি। ৬০ থেকে নানা বয়সের ৮৪ অবধি। তার
মাঝে ২ জন মহিলা। একজন ৬৮, অন্যজন ৭৮। বেশ দেখে শুনে ১৮ ই মার্চ ৩-৪৫ এর মিথিলা
এক্সপ্রেস এ উঠে পরলাম হাওড়া থেকে। রাতের খাবার হলো চিলি চিকেন আর রুটি। একটা
ক্লান্তিহীন আনন্দদায়ক মন নিয়ে গল্প আর ঘুম কে সঙ্গী করে পরদিন সকালে ৯ টা নাগাদ রক্সোল
। গাড়ি দাঁড়ানোই ছিল। তোলো তোলো লাগেজ তোলো। দিলাম রওয়ানা। আজকের গন্তব্য বীরগঞ্জ।
কিন্তু বাঁধসাধল জ্যাম আর ধুলো। গরম ও লাগছিলো, সদ্য এ.সি থেকে নেবে। বিহারের এই
অঞ্চল এখনো বেশ পিছিয়ে আছে, বোঝা যায়। কোনো পুলিশ এর ও দেখা নেই। অতএব সিনিয়র
সিটিজেনরা গাড়িতে বসে থাকো। খিদেও পেয়েছে, চা তেষ্টাও। ঘন্টাখানেক পর ছাড়া পেয়ে
বিহার থেকে নেপাল ঢুকে পরলাম। পুলিশেরও দেখা পাওয়া গেলো, আবার রাস্তাও খালি পাওয়া
গেলো। মন্দ নয় রাস্তা। ৭/৮ কিমি গিয়ে রানিসতী গেস্ট হাউসে উঠে পড়লাম। ৪বেড এর ৩ টি
ঘর। তবে বাঁচোয়া একটাই। তিনটিতেই ওয়েসটার্ন বাথরুম। নিশীথদার অর্ডারে সব্বাই হাজির
হলো চায়ের দোকানে। এক আমি ছাড়া। চায়ের নেশা যে তখন সকলের তুঙ্গে। দুধ চা। ওটি আমি
কোনোভাবেই গ্রহণ করিনা। ঘর দেখতে চলে গেলাম আমি। রুম ভাগটা একটু অদ্ভুত হলো।
একটিতে তরুনদা ( ৭৩ ) ও মলয়াবৌদির ( ৬৭ ) সাথে দীপিকাদি ( ৭৯ )। কাবাব মে হাড্ডি।
আরেকটিতে ব্যাটালিয়ান কমান্ডার রঞ্জনদা (৮৪), নিশীথদা ( ৭৭ ) শ্যামলদা ( ৭৬ ),
পুরুষোত্তমদা ( ৭৮ )এর সাথে আমি ( ৬২ )। আমরা ৫ জন হলাম একটিতে। সারাদিন এখানেই
থাকবো। সকলের ওপর নজরদারি চালানো টাও আমার আরেক নেশা। পাশের আরেকটি ঘরে তাপসদা (
৬৫ ), গৌতম ( ৬২ ) এবং রূপকুমার ( ৬১ )। আমাদের গ্রুপে কুমার আরো আছে। শ্যামল
কুমার ও তাপস কুমার। বাকি পরিচয় গুলো এখন নয়। যখন যেভাবে লেখা তে আসবেন। সে ভালো
কথায় হোক বা অপ্রিয় কথায়! ধুলো মাখা শরীরটাতে একটু জলের শান্তি মাখিয়ে, কিছু চিনি
ছাড়া লাল চা খেয়ে ছুটলাম রুটি সবজি খেতে। কেউ বা আলু পরোটা। ফিরে আমাদের ঘরের
প্রায় সকলেই স্নান এবং সামাজিক কাজকর্ম এ ব্যস্ত হলো একে একে। আসলে মানুষের
বার্ধক্য এসে গেলে কিছুটা শৈশব ফিরে পাওয়া গোছের ব্যবহার এসে যায়। আর এটা আমার বেশ
লাগে। তাই এদের সাথে মিশে শৈশব কে খুঁজে পাই। আবার এদের অভিজ্ঞতা গুলো, নানা
বিষয়ে, সে সাহিত্য হোক বা পুরান, মহাভারত হোক বা বিবেকানন্দ, অনেক অজানা তথ্য আমায়
সমৃদ্ধ করে। এই ভাবেই দুপুর। সোমাংশু এসে হাজির। আমাদের পেন এর মেম্বার মৈত্রেয়ীর
বর। মৈত্রেয়ী ভারী সুন্দর লেখে। ওর একটা অনু গল্পতো সারা হোয়াটস আপ ছড়িয়ে গেছিলো। সুগার
এ ক্যাডবেরি খাওয়া নিয়ে। ওরা এখানেই থাকে। একটি আলুমিনিয়াম কারখানার কেমিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ার ওর বর। সব ব্যবস্থা ওই করে রেখেছিল। মৈত্রেয়ী বিশেষ কাজে কলকাতা ফিরে
এসেছিল। তাই দেখা হয় নি। ভারী মিষ্টি মেয়ে। থাকলে হয়তো আরো অনেক সুবিধা পেতাম।
দুপুরে লাঞ্চ এ সোমাংশু ই নিয়ে গেল। থালি ৯৯ টাকা ( ভাত, ডাল, দুরকম সবজি, চাটনি,
পাঁপর) - যত ইচ্ছা আর চিকেন হাফ প্লেট ৯০ টাকা করে। নিশীথদা শুধু ডিম ( ৭০ টাকায়
দুটো )। শ্যামলদা ও তাপসদা ছোট মাছ। অনেকটা ট্যাংরার মতো দেখতে। দাম আছে বেশ। কি
যেন নাম বললো! এক প্লেটে ৭/৮ পিস। আঙুলের সাইজ। দাম নেপালি ১৮০ টাকা। পেট পুজো শেষ
করে চললাম ক্লক টাওয়ার এর দিকে, সবচেয়ে বড় বাজার এখানেই। এই মওকায় কিনে ফেললাম
গোটা ১২ প্লাস্টিক গ্লাস, শশা, পেঁয়াজ, গাজর, লঙ্কা, লেবু। কেন তা বলা যাবে না।
এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে, সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ঘরে। আমরা বেরোলাম জনা তিনেক। কিছু
কেনাকাটা তখন ও বাকি। রাতে পার্টি আছে না!! রানিসতী বলে কথা!! রসগোল্লা ১০ পিস
কেনা হলো ( আমি বাদে ),
ভুজিয়ার একটা বড় প্যাকেট ও হলো আর উল্টো দিকের দোকানে রাতের খাবার অর্ডার দেওয়া
হলো, আলু ফুলকপির তরকারি আর হাতে গড়া রুটি। সাথে রসগোল্লা। রঞ্জনদা গভীর আপত্তি
করলেন আমিষ এ। এখানে এনে খেতে। তাই ভণ্ডুল।
রঞ্জনদা
ও নিশীথদা ছাড়া আর কেউ বিশেষ জপ তপে বিশ্বাসী নয়। তারা বসে গেলেন একজন মন্দিরে
আরেকজন ঘরে।
দুজনেই
কেয়ার অফ রামকৃষ্ণ মিশন। আমাদের আড্ডা শুরু হলো। সাথে অমৃত এবং অমৃত সমান কথা
বার্তা। নানা বিষয়ে। স্যালাড কাটা হলো। ঠিক হলো রাত ১০ টার মধ্যে তাপসদা, গৌতমদা,
তরুনদা ও বৌদি এবং রূপদা গিয়ে খেয়ে, আমাদের পার্সেল নিয়ে আসবে। তাই হলো। আসলে এরা
কেউ মৃত সঞ্জীবনী তে বিশ্বাসী নয়। তবে কিছু আলোচনায় সত্যিই মন ভরলো। তরুনদার ছড়া
মন মাতালো। নিশীথদা কৃষ্ণ ও অর্জুন কে নিয়ে রম্য রচনায় মাতলেন। কৃষ্ণ হলেন
পুরুষোত্তমদা ( মুখে হাসি অথচ পারসোনালিটি আবার স্প্যানিশ অনুবাদক) আর অর্জুন
শ্যামলদা ( সব সময় কবিতার লক্ষ্যভেদ এ ব্যস্ত)। আবার দুজনের মিল ও খুব। বেড়াতে
গেলে এক ঘরেই থাকেন । এক খাটেই ঘুমান। আলাদা করলে রাগ হয়। প্রথম জন এর স্ত্রী বিয়োগ
আর দ্বিতীয় জন চিরকুমার। অবিবাহিত। প্রচুর বান্ধবী বলবো নাকি সখি বলবো !! রঞ্জনদার
নাম হলো ব্যাসদেব। সত্যিই জ্ঞান এর ভান্ডার। পুরান, বেদ, সংস্কৃতি, ইতিহাস এগুলো
নিয়ে একদম গুলে খাওয়া। আর আমরা নিশীথদার নাম দিলাম ভীষ্ম। আপত্তি করলেন না।
এভাবেই
রাত গভীর হলো। সকালে ওঠার তাগিদ। কারণ ৭ টায় বেড়োব। তার মধ্যে সকালের সৎকাজ, স্নান
ইত্যাদি । সকালে উঠে ফোর্স গাড়ি তে উঠে বসলাম আমরা ১১ জন। আমাদের হিসেবে ১৪ জনের
গাড়ি। বিহার আর নেপাল এর হিসেবে ১৬ জনের। সুতরাং বেশ হাত পা ছড়িয়েই বসা। বিলাসবহুল
নয় কিন্তু হারডি গাড়ি বলতে যা বোঝায় - তাই। ছুটে চললো ধুলো মাখানো রাস্তা দিয়ে,
কিছুটা বেশ খারাপ, কিছুটা আবার ৬ লেন তৈরি হচ্ছে। আসলে ৪ বছর আগে ভূমিকম্পে নেপাল
এর অবস্থা সত্যিই খারাপ হয়েছিল। এখনো সেই অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে আসতে
পারে নি, যদিও প্রচুর বিদেশি মুদ্রা ডোনেশন এসেছিল। যাই হোক আমরা সকলেই জানি এটা
গরিবের দেশ। ট্যুরিজম থেকে এর মূল আয়। আর একটি আয় ওদের আবগারি শুল্ক থেকে। একহাত
দূরে দূরে নামি দামি মদের দোকান। আর মদ খায়না এরকম মানুষ মেলা ভার। আমাদের ১০০
টাকায় ওদের ১৬০ টাকা পাওয়া যায়। এটা বেশ আনন্দের, কিন্তু খরচ করতে গিয়ে দেখা যায়
প্রায় একই পরে। গাড়িতে বেশ ঘুম জড়িয়ে এলো সকলের চোখে। আমি আর তরুণদা ছাড়া। আমাদের
ড্রাইভার ছেলেটি ভালো ড্রাইভ করে, হিরোইক কিন্তু হিন্দি বোঝে না, বলে তো নাইইই।
ইশারায় সব কিছু। ব্রেকফাস্ট হলো। ৪/৬ টা করে পুরি আর সবজি। সাথে গরম লেডিকিনি।
কৃষ্ণর অর্ডার হলো সে দুটো খাবে। লাল চা। এবার গল্পের পালা। ঝুড়ি খুলে বসা হলো।
আবহাওয়া খুবই সুন্দর। সকলেই ঠান্ডার জামা কাপড় এ আবোধ্য। কিন্তু কাঁচ খোলা যাচ্ছে
না। পেট ভর্তি তো!! ধুলো পেটে চলে যাচ্ছে। কিছুটা যাবার পর মুংলিং। এখন থেকে বা
দিকে পোখারা আর সোজা কাঠমান্ডু। চা আর হিসুর বিরতি অবশ্যই। আবার চলা শুরু।
কিছুক্ষন তাপসদার পেছনে লাগা, তার যত উল্টোপাল্টা কবিতা লেখা আর বেসুরো গান। ভারী
বড় মনের মানুষ। এবার আমাদের সাথে দিপিকাদি যাচ্ছেন। হান্ডিক্যাপড। অথচ সারা পৃথিবী
ভ্রমণ করেছেন প্রায় একসময়। এই নেপাল ও উনার দুবার দেখা। যেমন আমার এই নিয়ে চতুর্থবার(একবার
১৯৮০ তে ৬ বন্ধু মিলে, ১৯৯৩ এ ফ্যামিলি নিয়ে, ১৯৯৮ এ শুটিং এ এবং এবার)। আর সকলেরই
পশুপতি নাথ দর্শন প্রথম হবে। যাইহোক, উনাকে ধরা, উনার লাগেজ বওয়া ইত্যাদি আমার ছিল
তাই এবারে রঞ্জনদা কে ধরা এবং লাগেজ এর খেয়াল তাপসদার ওপর দিয়েছিলাম। এখনো ঠিকঠাক
খেয়াল ও রাখছে। সবচেয়ে বড় গুন। মুখে কোনো রা নেই। সব কাজ বলেদিলে করে ফেলেন।
মাঝে
একটি চালু দোকান দেখে এবারে লাঞ্চ সারলাম। ভেজ থালি ১৮০ টাকা করে। আজ আবার
পাহাড়িয়া দোল। প্রায় সব দোকান বন্ধ। সকলেই যার যার মস্তিতে । মহিলারাও। নেপাল নেশা
করার স্বর্গ্যরাজ্জ্য। খুঁজে পেতে দোকানটা মন্দ নয়। পৌঁছতে বিকেল হল। প্রায় ২৬০
কিমি। পোখারা পৌঁছানোর আগে দেখলাম প্রচুর রাস্তা বন্ধ। সব্বাই উদ্দাম নাচা গানা আর
সর্বসমখ্যে নেশায় ব্যস্ত। তার মধ্যেই ফাঁক ফোকর গোলে হোটেল এ হাজির। অসাধারণ
হোটেল। ব্যবস্থা করা ছিল। ফোনেও কথা হয়েছিল। রুম ও রেডি। যে যার ঘরে ঢুকে যাওয়া।
আঁধার কার্ড এখানে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য অবশ্যই জরুরি। মূলত হোটেল এ। তাপসদা কে
বহুবার বলা সত্ত্বেও সে ভোটার কার্ড নিয়ে হাজির। অবশেষে আমি গ্যারান্টার হতে ছাড়
মিললো। আমি এবং তাপসদা বেরিয়ে পড়লাম আশপাশ দেখতে। মূলত যেটা করি এত বয়স্কদের নিয়ে
আসা তো তাই হসপিটাল, ডাক্তার এদের ঠেকনা গুলো দেখে রাখা। লেক এর পাড় ও ঘুরে এলাম।
সকলেই বেশ উৎফুল্ল এত ভালো হোটেল পেয়ে। রাতে রঞ্জনদা দের ঘরে (এটা সবচেয়ে বড় ঘর )
আড্ডা তুমুল আর খাওয়া দাওয়া। চিকেন বা ডিম, সবজি রুটি। যে যেমন খাবে। সকলেই
ক্লান্ত শরীর বিলাসবহুল বিছানায় মেলে দিলো। আমিও বয়স্কদের দেখভাল করে নিজের ঘরে
এসে তিন নম্বর পেগটা আর চিকেন রুটি খেয়ে লেপের তলে।
সকালের
ঘুম ভাঙলো নীরব সূর্যের মুখর আলোয়। পর্দাটা সরিয়ে দেখি বেলা প্রায় ৮ টা। ৯ টায়
ব্রেকফাস্ট। ১০ টায় সাইড সিন দেখতে যাওয়া। সুতরাং নিত্যকর্ম সেরে চা খেয়ে চললাম
প্রাতঃরাস এ। এলাহী আয়োজন। প্যান কেক, টোস্ট, বাটার বা জ্যাম, ফল, অরেঞ্জ জুস,
সবজি, আলুর দম, ডিম সেদ্ধ, কি নেই!! চা, কফি, লিকার চা। গভীর ভাবে পেট পুজো শেষ
করে ১০ টায় বেরিয়ে পড়লাম সকলকে নিয়ে ওই ফোর্স গাড়িতেই। গাড়ির সামনেটা কৃষ্ণার্জুন
এর দখলে গেল। বাকি সকলেই যার যার জায়গায়। চললাম প্রথমেই বিশ্ব শান্তি স্তূপ। গাড়ি
থেকে নেবে ৪০৫ খানা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা। সত্যিই তো শান্তি পেতে গৌতম বুদ্ধ ও তো
কত পথ পরিক্রমা করেছেন। আমিও করে ফেলি ভেবে সর্ব প্রথম ওপরে উঠছিলাম আর খেয়াল
রাখছিলাম নিচের দিকে। এটা সিগারেট ছাড়ার সুফল। ৪০ বছর খেয়েছি আর ১০ বছর হলো
ছেড়েছি। পেছনে ছিল রূপদা ও গৌতমদা। এরা একটু নিজস্বতায় বেশি ব্যস্ত থাকে। বয়স্কদের
দিকে সেভাবে নজর করতে রাজি নয়। তবে রঞ্জনদা আর তাপসদা ও উঠলেন সাথে কৃষ্ণ, অর্জুন
ছাড়া। তরুণদা আর বৌদিও। শুধু নিশীথদা, দিপিকাদি, শ্যামলদা চায়ের দোকান এ বসে
রইলেন। এক কাপ কফি নাকি ৭০ টাকা। ফিরে এসে শুনলাম। ধন্য ভাই নেপাল। আমি এখানে সব
নেপালি কারেন্সির কথাই বলছি বা বলবো। তবে ওপরে উঠে মন ভরে যায়। সত্যিই যেন
শান্তিস্থল। নানা ছবি ওঠাতে ওঠাতেই দেখলাম সম্পূর্ণ পোখারা টা দেখা যায়। আর ডান
দিকে সম্পূর্ণ অন্নপূর্না রেঞ্জ। মোছলি পুচ্ছ ও একদম পরিষ্কার। গৌতম আর রূপদারা
নিজেদের ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিল। যাইহোক, কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে নেবে এলাম। ফেরার পথে
ধারা ফলস এবং মহেন্দ্র কেভ। ফলস দেখা হলো। পাহাড়ি ঝর্ণা। মহেন্দ্র কেভ এ কেউ যেতে
রাজি নয়। অনেক নীচে নেবে একটি পাথর। বলা হয় বিষ্ণুর রূপ। এবার লাঞ্চ এর পালা।
সকলেই নিরামিষাশী খাবার খেতে চাইলো। মাছ পাওয়া যায় না। কেউ আলুপরোটা, কেউ ভেজ মিল,
কেউ রুটি সবজি। সকালের ভারী ব্রেকফাস্ট এর এফেক্ট এখনো আছে বোঝা গেল। নিশীথদা তো
কিছুই খেলেন না। এবার গাড়ি নিয়ে পৌঁছে দিলো লেক এর পারে। একটা বোট নিয়ে ওরা গেল
মাঝের দ্বীপ এ পুজো দিতে। আমার এই নিয়ে বেশ কয়েকবার তাই আর গেলাম না। লেক এর পারে
বসে দেখি কত মায়েরা এসেছেন সেই সাউথ ইন্ডিয়া থেকে। দু একজন এর সাথে পরিচয় হলো।
পশুপতি নাথ দর্শন করে এখন বেরিয়ে ফিরে যাবেন যার যার জায়গায়। কত মালা কিনেছিলেন।
আমার মা ও যত জাগায় যেতেন আমাদের বউ এবং দিদিদের জন্য মালা নিয়ে আসতেন। এই সব
দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে বুঝতে পারছিলাম জীবনটা ছোট হয়ে আসছে। মায়ের কোলেই ফিরে
যেতে হবে যে। সম্বিৎ ফিরলো ওদের ডাকে। ফিরে এলাম হোটেল এ। রেস্ট সকলের। সন্ধ্যেতে
পোখারার অনন্য রূপ। শুধু বিদেশি। আর জাঁকজমক এ চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। প্রচুর বিদেশি
মুদ্রা আমদানি হয়। চুপি চুপি আরেকটা কথা বলি, এই বিদেশিরা এখানে খুব ফুর্তি করতে
আসে মহিলাদের নিয়ে। তার জন্য প্রচুর বাড়তি আয় হয়। তবে সত্যি সরকার এই শহর টিকে
একদম সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক এর মতোই বানিয়ে ফেলেছে। যাইহোক, হোটেল এ ফিরে এলাম ।
আবারো আড্ডা, কবিতা, আলোচনা কখনো গৌতম বুদ্ধ নিয়ে কখনো বা কার সকালে কেন পেট
পরিষ্কার হয় নি, সেই নিয়ে। কত মানুষের কত জীবনের কত সুখ দুঃখের কথা শুনলাম। আবারো সকলকে খাইয়ে,
ঘুম পাড়িয়ে , কল টাইম সকাল ৮ টায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে দিয়ে, নিজের ঘরে ফিরে ছোট্ট
লেপটার সাহচর্যে ঘুম এর জগৎ এ বিলীন হলাম।
অনেক
সকালে ঘুম ভাঙলো। আজ ফিরে যেতে হবে পোখারা থেকে। যতই হোক দু দিনের ভালোবাসাও
কিন্তু তাচ্ছিল্যের নয়। আমার মনে আছে যেবার ১৯৯৩ এ ফ্যামিলি নিয়ে এসেছিলাম পোখারা,
তখন হাতে গুনে ৩/৪ টে হোটেল আর বারান্দা থেকে লেক দেখা। আর লেকের জলে রিফ্লেক্ট
হতো মোছলিপুছা। এই ছিল পোখারা। আর এখন কয়েক হাজার হোটেল। পাহাড় কেটে সমতল হয়ে
গেছে। আর কোনোদিন আসা হবে কিনা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়লাম বরফ এর পাহাড় দেখতে।
১৪,০০০/- টিকিট। হেলিকপ্টারে ৪০ মিনিট। ভারী সুন্দর। ফিরে এসে দেখি সকলেই উঠে
পড়েছে। ব্রেকফাস্ট বুফেতে যাবার সময় বিল রেডি করতে বলে দিলাম। ছেলে গুলোও ভারী
মিষ্টি। বললো বিল রেডি স্যার। রুম চেক আউট করে গাড়িতে মাল তুলে নিলাম। চললাম
কাঠমান্ডু। পেট ভর্তি, সকালে ওঠা ইত্যাদির কারণে একটু চোখটা বুঝতে চাইছিলো, কিন্তু
এমন একটা কবিতার সাবজেক্ট তুলে দিলাম রঞ্জনদা ও নিশীথদার কাছে, যে জমে গেল আলোচনা।
শিক্ষিত মানুষদের সাথে ভ্রমণ এর এটাই সুবিধা। আমিও নকশাল পিরিয়ড এর দু তিনটে গান
শোনালাম। বেশ মনে আছে দেখলাম। আমরা যারা ভারতবর্ষের ৭০ এর দশক দেখেছি, বাংলাদেশ এর
৭১ দেখেছি, ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সি দেখেছি, তাদের ঝুলি ঠাকুরমার ঝুলি। আর
যারা ইডেন এর ১৪ জনের মৃত্যুর সাক্ষী ছিল ক্রিকেট নিয়ে বা ৮২ তে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল এর খেলার
সাক্ষী ছিল, তাদের ঠাকুরদাদার ঝুলিও ভরা। সেরকম ই নানা আলোচনা চললো । তারই মাঝে
বেশ কয়েকজন ঘুমিয়েও নিলো। মুংলিংএ পৌঁছে একটা চা ব্রেক। একটু ঘুরে ফিরে দেখে নেওয়া।
পাহাড়ি সৌন্দর্য বেশ ভালো। ততোধিক ভালো নারী পুরুষরা। মুখে একটা হাসি লেগেই আছে সকলের।
লোকাল বিস্কুট ও মন্দ নয়। আবার ও চললাম। ১৫ কিমি আগেই টের পেলাম কাঠমান্ডু আসছে।
একে রাস্তা খারাপ , সাথে ট্রাফিক জ্যাম হওয়া শুরু। এবারে ট্রাভেল করলাম ২১০ কিমি।
পৌঁছে গেলাম কাঠমান্ডু। হোটেল ও বুক করাই ছিল। মাঝে একটা খুব চালু দোকান এ লাঞ্চ
সেরে নিয়েছিলাম সকলেই। আতপ চাল আমার আর নিশীথদার সহ্য হচ্ছিল না। তাই চাউমিন
খেলাম। দিপিকাদিও তাই খেলেন। বাকি সকলেই ভেজ থালি।
কাঠমান্ডু
তে পৌঁছে হোটেল এ উঠলাম। পোখারার মতো এত ভালো ঘর নয়, তাই একটু এদিক ওদিক করতে হলো।
নানা সুবিধা অসুবিধার মধ্যেই যার যার রুম এ সেট হয়ে গেলাম। এবারের আড্ডাস্থল হলো
আমার ঘর। চা বানানো থেকে নৈশ ভোজ। সব কিছুর জন্যই। সব্বাইকে বললাম বেরোনোর কথা,
কিন্তু সকলেই তখন রেস্ট এর ভাবনায়। আমি বেরিয়ে পড়লাম। সাথে তাপসদা। হেটে পৌঁছে
গেলাম থামেল এ।
কাঠমান্ডুর
সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গা। ওয়াকিং স্ট্রীট আছে, আছে ড্যান্স বার। তাপসদার চোখ কপালে। সব
মেয়েগুলো সাজুগুজু করে ডাকাডাকি করে। এসব দেখতে দেখতে ফেললাম রাস্তা হারিয়ে।
কোনোরকমে আবার ও খুঁজে এসে দেখি, আমাদের হোটেল এর কাছেও কিছু মহিলাদের বিচরণ কোন
নেই। শুনলাম ৬০ শতাংশ মহিলা নাকি এই জাতিও কার্যক্রম এ জড়িত থাকে। খুব দুঃখ হচ্ছিল
মেয়েগুলো কে দেখে। কি আর করা যাবে !! ফিরে এসে অনেককে গল্প বললাম। অনেকে দেখতে
চাইল। নৈশভোজের আগের আড্ডা টা এই আলোচনায় কেটে গেল। কৃষ্ণ, অর্জুন, ব্যাসদেব বা
ভীষ্ম, সকলেই এই সম্বন্ধীয় আলোচনায় মন মাতালো। পুরানো দিন থেকে আজকের দিন অবধি।
স্প্যানিশ নারী নিয়েও চললো কিছুক্ষন। এই স্পানিশদাদা নাকি রোজ রাতে একটা মিষ্টি
খেয়ে ঘুমান। দুদিন পোখারাতে পাওয়া যায় নি। আজ আমি জোগাড় করে নিয়ে এসেছি। অবশেষে
খাওয়া দাওয়া সেরে যার যার ঘরে। পরদিন সকালে ৮ টায় বেরোনো পশুপতি নাথ দর্শনে।
সকাল
হতেই সকলেই চা চা করতে থাকলো। যার যার গ্লাসে আমার ঘর থেকে চিনি ছাড়া লাল চা নিয়ে
গেল। কেউ কেউ সুগার ফ্রী নিয়ে ঘোরে। শ্যামলদা একজন তার মধ্যে। অর্জুন এর মুখ
মিষ্টি না হলে চলবে কেমন করে?? স্নান করে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে তার ওপর কালো লেদার
জ্যাকেট পরে বেরিয়ে দেখি প্রায় সকলেই পায়জামা পাঞ্জাবিতে। দু একজন ছাড়া। ড্রাইভার
ও রেডি। চললাম জয় বাবা পশুপতিনাথ। গেটের কাছে নাবিএ দিলো। হান্ডিক্যাপড এবং সিনিয়র
সিটিজেন দের গেট অব্দি পৌঁছানোর ব্যাটারি অপরাটেড গাড়ি আছে। উঠে বসলাম অনেক কে
নিয়ে। যার যার মতো দল ভাগ হয়ে গেল। আমি দিপিকাদিকে নিয়ে পুজো নিয়ে চললাম মন্দিরে।
উল্টো গেট দিয়ে ঢুকে দুজন এসে আমাদের একদম সামনে নিয়ে গেল। মহিলা ভলান্টিয়াররা হাত
দিয়ে গার্ড করে দিপিকাদি কে দর্শন করিয়ে দিল। আমারও দর্শন হলো। দিপিকাদি কেঁদে
ফেললেন। আমার হাত দুটো ধরে বলতে থাকলেন, "তুই আমায় আবার দর্শন করালি মহাদেবকে
!! তোর ভালো হবেই"। দেখি চোখে জল। আমিও কেমন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। মনে হলো
যাদের এভাবে বেড়াতে নিয়ে যাবার কেউ নেই , তাদের বেড়াতে নিয়ে আসা যে কি আনন্দের।
অথচ এক সময় এই দিপিকাদি সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। এক জায়গায় দিপিকাদিকে বসিয়ে
অন্য গেট এর দিকে গিয়ে আবারো দর্শন হলো। একা মনে মনে বললাম , "হে মহাদেব..
বিশ্বত্রাতা.. এদের কাউকে ভুগিও না"। নেবার হলে এমনি নিয়ে নিও।"
প্রনামির বাক্সে একশো টাকা দিলাম। ফিরে এলাম রঞ্জনদা আর নিশীথদার খোঁজে। দেখি
লাইনে দাঁড়িয়ে। ডেকে নিলাম দুজনকেই। দুই হাতে দুজনকে ধরে ওই ভিড়ে এগিয়ে চললাম সেই
রাস্তায় যেখান দিয়ে মহিলা ভলানটিয়ার দিপিকাদিকে ঢুকতে দিয়েছিলেন। আমায় দেখে দুই
হাতে দুজনকে দেখে একজন কে আমার হাত থেকে নিয়ে সোজা সামনে নিয়ে দাড় করিয়ে পূজারীকে বললেন
এদের পূজা হবে। নিশ্চিন্তে পুজো দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বার বার তিনবার আমার দর্শন হলো।
এদের ইচ্ছায়। এবার বেরিয়ে এলাম। রঞ্জনদা অবাক হয়ে আর্ট দেখতে দেখতে কোন দিকে যে
চলে গেলেন, বুঝলামই না। দিপিকাদি কে ছেড়েও যেতে পারছি না। সাথে আবার নিশীথদা। তাও
এক জায়গায় দাড় করিয়ে এদিক ওদিক খুঁজে এলাম। দেখি প্রায় সকলেই সেই পুজো দেওয়ার
দোকান এ এসে পৌঁছেছে। একমাত্র রঞ্জনদা ছাড়া। রঞ্জনদার পুজো প্যাকিং করে আরেক হাতে
জুতো নিয়ে এসে দাঁড়ালাম গেট এর কাছে, যেখানে গাড়ি নাবিয়েছিলো। না। এখানেও নেই।
দেখি গৌতম এবং রূপ দুজনে বসে আছে। খুব রাগ হলো। কোনো বয়স্ক মানুষের সাথে না এসে
দুজনে দাঁড়িয়ে আছে!! মানুষের এরকম মানসিকতা ও হয়!! যাই হোক দাঁড়িয়ে রইলাম। তাপসদা
নিজেকে গিলটি ফিল করছিল। পাঠালাম আরেকবার খুঁজতে। ততক্ষনে আমি ঘেমে নেয়ে অস্থির।
পাঞ্জাবি দেখে মনে হচ্ছিল স্নান করে ভেজা গায়ে পড়েছি। আরেক বার প্রণাম জানালাম
পশুপতিজি কে। কতটা জাগ্রত সেটার আরেকবার প্রমান দিলো। খবর পেলাম পাওয়া গেছে রঞ্জন
দাকে। আমার মা বলতেন, " বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর"। ধন্যবাদ
দিলাম আরেকবার মহাদেব কে। আরেকবার দিয়েছিলাম কেদার যাবার পথে। সে অন্য ঘটনা। গাড়ি
ডেকে নিলাম। ফিরে এলাম হোটেলে। আজ আবার নেপাল পেন থেকে ৩ টের সময় একটা কালচারাল
এবং পোয়েট্রি মিট আছে। সেটা এখান থেকে একটু দূরে। তাই সকলকে ১ টায় লাঞ্চ এর সময়
দিয়ে, ২ টোয় বেরোনোর প্রোগ্রাম করলাম। ভেজ থালি সাথে রুহি মাছ ভাজা। সব্বাই খুব
তৃপ্তি করে খেলো। ২.৪৫ এর একটু আগেই পৌছালাম ৮ ডিগ্রি হল এ। বেশ ভালো ব্যবস্থা।
অনেক নামি মানুষ জনের সাথে পরিচয় হলো। কিছু কবি, কিছু সাহিত্যিক, এমন কি বেশ কিছু
ডক্টরেট মানুষজন কেও পেয়ে গেলাম। নানা কথা, কবিতা, আলোচনায় শেষ হলো ৬ টা নাগাদ।
হাই টি। নানা স্ন্যাকস সাথে চা বা কফি। অভিনন্দন, ভালোবাসা এবং সি অফ এর সীমানা
পেরিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। আজ সকলের মুডই ভালো। এরকম একটি
অনুষ্ঠানে পার্টিসিপ্যান্ট হয়ে। বেরোলাম সকলে মিলে সামনের বাজারে। কিছু কেনাকাটা
হলো, কিছু আড্ডা আবার ঘরে ফিরে এসে।
পরদিন
সেরকম কিছু ছিল না দেখার মতো। স্বয়ম্ভুনাথ এবং রাজার পুরোনো বাড়ি। আগে রাজ শাসন
ছিল এখানে। বছর ৫/৬ হলো এখন গণতান্ত্রিক দেশ হয়েছে। আর সুযোগ হলে মনে মনে ভাবলাম
এদের ক্যাসিনো দেখিয়ে দেব। কি হয় গ্যাম্বলিং !! বুদ্ধ রুপি স্বয়ম্ভুনাথ কে দেখে
চললাম রাজার বাড়ি। কিন্তু খুবই দুঃখজনক রাজার বাড়ি দেখতে নাকি সার্ক কান্ট্রি
গুলোর মানুষদের এক একজনের ২৫০ টাকা লাগবে। নেপালের রাজা, ভারতের কি ?? রঞ্জনদার
একটু ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেটা সংবরণ করলেন তরুণদার বৌদির শরীর খারাপে। আর কেউ যেতে
রাজি হলেন না। তার ওপর আবার অনেক হেঁটে ঢুকতে হবে। ফিরবার পথে দেখি একটি ক্যাসিনো।
গাড়ি দাড় করিয়ে সক্কলেই প্রায় আঁধার কার্ড দিয়ে পাস পেয়ে গেল। শুধু ঢুকলেন না
তরুনদা এবং বৌদি, আর তাপসদা। এদের বহুবার বলা সত্ত্বেও এরা কেউ আই কার্ড সাথে নিয়ে
ঘুরছিলেন না। খুব কপাল ভালো যে কোনো বড় দুর্ঘটনায় পড়েন নি। এটা সকলেরই মনে রাখা
উচিত পকেটে আঁধার কার্ড এর নিচের পার্টটা রাখা। সে দেশ হোক বা বিদেশ। যাই হোক, আমি
ছাড়া আর কেউ কিছু খেললো না। আর আমি মেশিন এর গেমে ব্যস্ত হলাম। আমার হয়ে রঞ্জনদাও
খেললো। উঠে নেবে ২০০ টাকা হারালাম। আর এখানে দেখলাম বেটার হ্যান্ড, তিন তাস বা
রামি খেলার কোনো অবকাশ নেই। আসলে এখন এদের গভর্নমেন্ট অনেক কেই লাইসেন্স দিয়েছে
ক্যাসিনো খোলার। আগে একটাই ছিল হোটেল ইয়াক এন্ড ইয়েতি। বিশাল বড়। এখনো নাকি
ক্যাসিনোর বাস সব নামি হোটেল থেকে নিয়ে যায় এবং ফেরত দিয়ে যায়, সে যত রাত ই হোক।
কিন্তু আমাদের কেউ ইন্টারেস্টেড হলো না এন্ট্রি ফি শুনে। ১০ ডলার। আর যদি খেলা,
খাওয়া এবং ড্রিংকস করা হয় তবে ওই ১০ ডলার এডজাস্ট করা হয়। এখন ওবেরয় গ্র্যান্ড
থেকে ছোট ছোট গোটা দশেক। আমি যেবার বন্ধুরা এসেছিলাম সেবার প্রায় ৬ হাজার টাকা
জিতেছিলাম। সেটা ১৯৮০ সাল। তখন নেপাল বিদেশি জিনিসের রাজ্য ছিল। কতকিছু যে
কিনেছিলাম। তিনটে নাগাদ ফিরে এলাম খাবার হোটেল এ। বিয়ার সহযোগে লাঞ্চ হলো। আসলে এই
নেপাল এ সব রেস্তোরাঁতেই মদ এর লাইসেন্স হয়। কিন্তু রাত নয়টার বন্ধ। তারপর বিক্রি
হচ্ছে দেখলে লাইসেন্স ক্যানসেল। আর রাতে জমে ওঠে ড্যান্স বার গুলো। তুমুল জোরে গান
চালিয়ে দেয়। সাথে হ্যাসেস, চরস, গাঁজা সবই খোলা মেলা সাথে নেপালি মহিলারাও। এই সব
অভিজ্ঞতা নিতে নিতে কিনে ফেললাম কিছু গিফট। মূলতঃ ট্র্যাক লোয়ার। বেশ ভালো। মেড ইন
ব্যাংকক ই বেশি। কিছু চীনেদের মাল ও রয়েছে। আর এখন নেপালি মহিলারাও বেশ কিছু ড্রেস
বানাচ্ছে। স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছায়। রাত্রে যে যার মতো খাওয়াদাওয়া করলেন। কৃষ্ণ আর
ব্যাসদেব বিয়ার সহযোগে চিকেন মোমো। দিপিকাদিও মোমো। আমি চাউমিন, বাকি চিকেন সবজি
রুটি। গতকাল রাতে নিশীথদার একটু শরীরটা গন্ডগোল হয়েছিল। আমায় ডাকেন নি। রুম
পার্টনার রঞ্জনদা সামলে নিয়েছিলেন।একটু আশ্বাস দিয়ে বললাম কোনো চিন্তা নেই, ঘুম না
এলে আমায় ডাকবেন।
পরদিন
সকালে সক্কলে রেডি, ফিরে আসার পথে। ব্রেকফাস্ট করে, লাগেজ তুলে রওনা দিলাম তখন
প্রায় ৯ টা। আবারো সকলের চোখ জুড়িয়ে ঘুম নেমে এলো, কিছুটা রাস্তা পার হতেই। কিন্তু
এত ট্রাফিক, কে ঘুমাবে? সকলেই উসখুস। প্রায় ১ টি ঘন্টা ধাক্কা খেতে খেতে বেরোনোর
সুযোগ পাওয়া গেলো কাঠমান্ডু থেকে। সামনের সিটে বসে কৃষ্ণার্জুন ও ঘুমে কাতর। আসলে
কৃষ্ণর বুকে ঠান্ডা লেগেছে। একটা সাই সাই শব্দ চলছে অনবরত। সকলের দৃষ্টিই প্রায় প্রথম
সিটে। এই সব হতে হতে প্রায় ১ টা নাগাদ এসে পৌছালাম মনকামনা মন্দির। এর আগে যতবারই
এসেছি, কোনোদিনই এই মন্দিরটি ছিলো না। তাই আরো বেশি ইন্টারেসটিং লাগলো। এখানে নাকি
শুধু কেবল কার এ যাওয়া যায়। জন প্রতি ৮০০ টাকা যাওয়া আসা। ভারতীয় মুদ্রায় ৫০০।
অবশ্য নেপালি হলে ৩৪০ টাকা। যেতে মন্দ লাগলো না। ১০ মিনিটের রাস্তা। নামার পর ও
বেশ খানিকটা রাস্তা ও গোটা ১০০ সিঁড়ি হেঁটে যেতে হয়। মন্দিরে পৌঁছে দেখি বিশাল
লাইন পুজো দেওয়ার। কিন্তু এ কি? এ তো পুরো একটা শহর! মাল্টি স্টোরিড থেকে কি নেই!
এ রকম শহর কবে তৈরি হলো! আরো আশ্চর্য হচ্ছিলাম এখানে যাওয়া আসার রাস্তা কি শুধু
কেবল কার! যা বুঝলাম গাড়ির রাস্তাও রয়েছে। কিন্তু সেটা কোনো ট্যুরিস্ট কে দেখানো
হয় না। খুবই ভালো আয় এর রাস্তা,এখান থেকে সরকারের। এভারেজ যদি ৫০০ জন যাওয়া আসা
করে ৫০০ টাকা করেই ধরলাম। ২ লক্ষ ৫০ হাজার।কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলাম যেখান থেকে
উঠেছিলাম। কারণ অনেকেই যায়নি, তারা অপেক্ষারত। ৩.১৫ নাগাদ ফিরে এলাম। গাড়িতে উঠে
আগে লাঞ্চ এর খোঁজে। যদিও ওপরে প্রচুর দোকান খাওয়ার জন্য, কিন্তু সকলে তো ওখানে
যায়নি, তাই। মুংলিং পৌঁছে খাবার এর দোকানে ঢুকে গরম গরম ভাত, ডাল, সবজি , চাটনি,
পেঁয়াজ , লঙ্কা সাথে একটু মিষ্টি দই অমৃত সমান মনে হলো। আমি আর নিশীথদা রুটিতে
ভোজন সারলাম।তারপর কিছুটা নেবে আসার পর শুরু হলো লড়াই। সেই যাবার সময় এর খারাপ,
ধুলোর রাস্তাগুলো। যত উঁচুনিচু, তত যেন তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর তাগিদ।এই ভাবতে ভাবতে যখন
পৌছালাম সেই রানিসতী গেস্ট হাউসে, তখন প্রায় ৮.৩০।
আসলে
কাঠমান্ডু থেকে শিলিগুড়ি হয়েও ফেরা যায়, কিন্তু সে প্রায় ৪৯০ কিমি। তাই এই রাস্তায়
আবার ফেরা। এই রাস্তায় ট্রেন এর জার্নি একটু বেশি। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে
পরা। সকলেই ক্লান্ত। আবার সকালেও বেরোব ৭ টার মধ্যে। যাতে কোনো জ্যাম এ না পরি।
সকাল
৮ টায় পৌছে গেলাম রক্সোল। নিজের দেশে। ভারত। আমার ভারত। গরম গরম পুরি ভেজে দিচ্ছে।
সাথে জিলিপি। এই মিথিলা এক্সপ্রেসে কোনো খাবার এর ব্যবস্থা নেই। এটা বড়ই খারাপ।
রেলের এই গুলো দেখা উচিত। তাই বেশ কিছু হাতে গড়া রুটি, সবজি, ডিমের ঝোল, টিন
প্যাকড রসগোল্লা, বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুর, ভুজিয়া ইত্যাদি কিনে ওঠা হলো এসি 3
টায়ারে। ট্রেন ছাড়লোও ঠিক সময়ে। পৌছালাম ও পরদিন সকালে ৪.১০ এ। সকলকে খেয়াল করে,
স্টেশন এর বাইরে এসে দেখি প্রচুর ট্যাক্সি। সবাইকে সি অফ করে ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে
এলাম বাড়ি। মনটা ভারাক্রান্ত। এত দিনের এরকম একটা আনন্দমুখর সময় কিভাবে যে কেটে
গেলো, ভাবতে ভাবতে ফোন করা শুরু করলাম সকলে বাড়ি ফিরেছে কিনা জানতে। কিছু ফোন এ
খবর পেলাম আর কয়েকজন ফোন করে খবর দিলো। সকলেই পরের বেড়ানোর জন্য তৈরি হওয়ার কথা
বলে ফোন ছাড়লো। সত্যিই মনটা খুব খুশিতে ভোরে ওঠে, যখন এদের সকলের মুখে আনন্দের
ঝিলিক দেখতে পাই।
No comments:
Post a Comment