বসে আছি হরিদ্বারের হর কি পৌড়ি গঙ্গা ঘাটে। উত্তরাখন্ডে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে
গঙ্গার নিস্ক্রমন। এখানে আছে ব্রহ্মকুণ্ড জল আবর্ত,যেখানে নাকি ডুবকি লাগলে সব পাপ নাশ হয়ে যায়। এখানে নাকি সমুদ্র মন্থনের
সময় এক বিন্দু অমৃত কলস থেকে উপচে পড়েছিল। পাপ কি, অমৃত কি, হরির প্রবেশ দ্বার হরিদ্বার কি, প্রকৃতির মহিমময়
তীর্থ কি আর প্রকৃতিই বা কি,সবকিছুর পরিভাষা বদলে গেছে। হর
কি পৌড়ির ঝাঁ চক চক বাঁধানো ঘাট আর লাল হলুদ বার্ণিশে গাবানো মন্দির দেখে মনে হয়
ব্রহ্মকুণ্ড না বলে ছট তালাও রাখা গেলেও কোনও তফাত হতো না। হৃষীকেশেও মার্বেল
স্টোনের মানবাকৃতি দেবতাদের ভিড়। মূর্তিগুলির আধুনিকতায় প্রকৃতির আদি সৌন্দর্যে
কৃত্তিমতা এসেছে। প্রকৃতি মৌলিকতায় থাকলে তার অমূর্তভাবের রস পান করার এক আলাদাই
অনুভুতি। আসলে প্রকৃতি মানেই হোলো স্থাবর জঙ্গমের দৃশ্যগত চেতনা। বিশালত্ব ও
সৃষ্টিরহস্যের অনুভব বিস্ময় হয়ে মানুষের কাছে আসে ও অন্তর্মুখী হয়ে তার অতিচেতনাকে
জাগায়। নান্দনিক অনুভূতির উন্মেষ ঘটায়। এইসব অনুভূতির সাথে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত
মার্বেল টাইলসের বেমানান আধিক্য মানুষের ভিতরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। প্রাণ যা
চায় তা পায়না।
অবশ্য প্রকৃতি আমাদের কাছে সমগ্র
চেতনা হয়ে আসে না। তার বিশালতার পরিমাপ সম্ভব না। সজীবতার পাশে ভয়াল রুক্ষতা
আনন্দের সাথে ভয় এই বিপরীত ভাব আমাদের মনে একসাথে কাজ করে। আর এই মিশ্র ভাবনাই
সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পনে বাধ্য করে। কিন্তু ভুল ও স্বার্থী মানুষের চাহিদা
অনুযায়ী এই পরম শুদ্ধ অনুভুতির ভুল ব্যাখ্যা মানুষের মনে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। আর
এখানেই স্খলন ও পতন। সরল ও নির্বাধ হলে যে বিস্ময় কতো যে আনন্দদায়ক হয় তা সবাই
জানে। কৃত্তিমতা যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটাও সবাই বোঝে। কিন্তু এই
কৃত্তিমতার জন্যে প্রকৃত জ্ঞান থেকে মানুষ সরে আসছে,সেটাই চিন্তার বিষয়।
কিছু মানুষের চরিত্রে ক্ষতিকর এমন
প্ল্যান থাকে যাতে করে সে আগ্রাসী চেষ্টা করে বহুলোকের মনকে সংক্রমিত করতে। সাধারন
সরল ও সমর্পিত মানুষের জন্য তা বিষময়। প্রকৃতির প্রকৃতবোধ তাই ওই সংক্রমিত মানুষের
মনে ছাপ ফেলতে পারেনা। ভুল বিস্ময় ভুল জ্ঞান সে পরে আবার অন্যের মনে বসিয়ে দেয়। এই
ক্ষতিকারক মিথ্যাবোধ সাধারন জনতায় ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমটি হোলো শিল্প ও ধর্ম। ভুল
শিল্প ও ভুল ধর্মীয় ভাব প্রকৃতির নির্জন ঘন গোপন স্থলের দিকে যত এগিয়ে গেছে ততই
প্রকৃতি তার আসল রূপ সরিয়ে নিয়েছে। প্রকৃতি তখন সেখানে নেহাত স্ন্যাপ ছাড়া কিছুই
থাকেনা।
প্রকৃতিকে অনুভব করার শুদ্ধানন্দ
চেতনা কি তা দার্শনিক রুশোর উপলব্ধি দিয়ে বোঝা যেতে পারে। ‘…হঠাত্ যেন হাজারটা উজ্জ্বল স্নিগ্ধ আলো আমার চোখ ধাধিয়ে দিল।
অসংখ্য প্রশ্ন আমার মনে ভিড় করতে লাগলো আর সেই প্রশ্নে উত্তেজনায় আমার সমস্ত
স্বত্ত্বা চঞ্চল হয়ে উঠলো। এই অবস্থায় প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল তারপর যখন আমি উঠে
দাঁড়ালাম তখন এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে, চোখের জলে আমার
জামার সামনের দিকটা ভিজে গেছে আমি টের পেলাম। ওই গাছতলায় বসে প্রকৃতির যে অনুভব আর
উপলব্ধি আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছিল,তার সিকিভাগও যদি আমার
লেখাতে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম,আমাদের ভাবপ্রকাশের জন্য সমাজে
যে বৈষম্য ও বিরোধ হচ্ছে তা কিছুটা কম হতো’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গান
এমনই যে প্রকৃতির ওই শুদ্ধচেতনার প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্ব আমরা পরোক্ষ ভাবে অনুভব
করতে পারি। কিন্তু তা আর কতো জন? এবং ধীরে
ধীরে তাও আবার কমে আসছে। এখনকার কবিতায় সেই ভাব অনুভুতি আর কোথায়? যে কবির কাছে তাও বা আছে,তিনি ব্যাকডেটেড হয়ে যাবার
ভয়ে সেরকমটি আর আমাদের কাছে প্রকাশিত হন না। এখন কবিতার একটি কোনো লাইনে যদিবা
প্রকৃতি ভাবে আপ্লুত হতে যাচ্ছি,পরের লাইনে এসে সেটা নির্মম
ভাবে মুছে যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
প্রকৃতি রসভাবের বর্ণনার একটু নমুনা দিলাম। ‘…প্রচুর
সুপুষ্টু গাছগুলা গাঢ় সবুজ স্বাস্থ্যে বড় মনোরম। ...এতো সজীব গাছগুলো,মনে হয় যেন অনেকগুলো প্রাণের সাহচর্যে আছি। কয়েকদিন থেকে মনটা ভারাক্রান্ত
রয়েছে। ছোটোবড় অনেক আশা নিরাশা,নিরুদ্যম,অদৃস্টের প্রতিকূলতা...। আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম,হঠাত্
সংগীতের স্বর উঠল। অন্ধকারের মধ্যে হঠাত্ যেন সৌন্দর্যের আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
মনটা যেন বলে উঠল,এই হয়েচে। আমি এই জিনিসটাই হারিয়ে এরকম হয়ে
পড়েছি। এই সৌন্দর্য,যা আমার মূল রস,
অক্ষমতা হতাশা আর সবচেয়ে বেশি অন্ধ আশঙ্কার জন্য যা আমি তিলে তিলে হারাতে বসেছি।
হে বন্ধু (প্রকৃতি) ! ধর্মের পাশে পাশে এই যে আবিলতা এসে পড়েছে,এ থেকে আমায় পরিচ্ছন্ন রাখ। এ আমায় মোহাচ্ছন্ন করে আমায় তোমামুখী দৃষ্টিকে
ব্যাহত করেছে...’।
আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে এই সবুজ
আলোটি রয়েছে। ক্ষীণ হলেও বা। যখন বহির্মন অন্তর্মুখী হয় আর এই রশ্মিটুকু ক্ষণিকের
জন্য হলেও অন্তর স্পর্শ করে,তখন,বুকে হাত দিয়ে বলুন তো,আপনিও কি বিভূতিবাবুর মতো
আকুল হয়ে এমনই প্রার্থনা করেন না?
প্রকৃতি
কেবল জড় ও সজীব পদার্থের সমষ্টি নয়। জার্মান ভূগোল বিশারদ আলেকজান্ডার ফন
হ্যামবোল্ট প্রমাণ করেছেন,প্রকৃতি এক পবিত্র শক্তি যার আধার হচ্ছে এই
পৃথিবী। শক্তি অমূর্ত আর তার প্রকাশ এই পৃথিবী। শক্তি অনুভবের। বাহ্যিক ইন্দ্রিয়
দিয়ে অনুভবের কিন্তু বস্তু বিশ্লেষণের নয়। এখন বসে থাকতে থাকতে মনে হলো এতো মানুষ
এখানে কেন এসেছে? গঙ্গার কুলুকুলু শব্দের আমেজে তন্দ্রিল
প্রকৃতিকে হনন করতে? প্রতিমুহূর্ত ঘণ্টানাদ ও শ শ মানুষের
আর্তনাদে নীরবতার লেশ মাত্র নেই। ধ্বনি শক্তির যথেচ্ছ ক্ষয়।শত শত আগুন জ্বালিয়ে
যখন গঙ্গা বক্ষ দহন হচ্ছিল তখন হঠাত্ মনে হলো গঙ্গা বুঝি অভিমান করে আমাদের কাছ
থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment