আমাদের বাড়িটা ছিল ভৈরবের গা ঘেঁষে,সকালে মাঝি মাছ এনে বিক্কিরি
করবার জন্য চিৎকার করত যখন,তখন আমাদের ধোয়া জামাকাপড় পড়ে ইস্কুলে যাবার জন্য তৈরী
হওয়া প্রায় শেষের পথে..।' ছোটবেলা রাতে খাওয়া দাওয়া করে দিদার কোল ঘেঁষে শুতে গেলে
এই বাক্যগুলোই আবহসঙ্গীত ছিল। তারপর চোখের সামনে খুলে যেত এক আশ্চর্য জগৎ। যে জগৎ
ফেলে যে আসেনি, সেও খানিক বুঝতে পারবে যে কি ফেলে আসতে হয়েছে। এসব গল্প বলবার দিনে
সমস্ত দৃশ্য,শব্দ,গন্ধ মথিত হয়ে উঠত আমাদের শোয়ার তক্তপোষটায়।মন্থন হতো ঠাঁইনাড়া
মানুষটার মনে, মানুষটা লাফ মেরে ফিরে আসত নিজের মাঝে, নিজের গহীন থেকে থেন দিদা
তুলে আনত বহু পুরোনো,কিন্তু আদরে-সোহাগে ঝলমল করা এক 'আমি'কে।দিদা তখন ভৈরবে
সাঁতার দেবার কথা বলত,পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটা ধরা পড়ে যেত স্মৃতির হাতে,হারিয়ে
যেত সময় আর পরিসর। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধার পনেরো বছরের বালিকা হবার দেশভাগের মতো
যন্ত্র আর খুব বেশি নেই। আমি কখনো সে জায়গায় সশরীরে যাইনি, তবে যাইনি যে তা বলতে
পারি না।দিদা যে ছবিটা নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল সে ছবিটাই ,পারা বেরিয়ে আসা আরশীতে
প্রতিফলিত হয়ে আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে যেন।আমি মনে করলেই সে গ্রামের আনাচে কানাচে
ঘুরতে পারতাম।এখনও পারি।
ক'দিন আগে,খুলনার এক ছোটকাগজের
সম্পাদিকার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ হয়েছে। বস্তুত, পলাশমারি গ্রামের বাসিন্দা দেখে
নিজেকে আর সংবরণ করে উঠতে পারিনি,বন্ধুত্বের আবেদন পাঠিয়েই ফেলেছিলাম। দু-চার কথার
পর ,বললাম 'কয়েকটা ছবি দেবে তোমাদের গ্রামের?' বলে ফেলে ভাবছি, আদৌ উচিত হল কি
চাওয়া এত স্বল্প আলাপে,একে সুন্দরী,তায় কাঁটাতারের ওপাশ..ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবলেও
যেহেতু মেসেঞ্জারে মুছবার সুযোগটা আমার মুঠোফোনে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কাজ করেনা
,তাই করবার কিছুই ছিল না।
ছবি এসে গেল-প্রায় গোটা
পঞ্চাশের মতো।সেসব ছবি দেখতে গিয়ে কিছুই মিলল না।প্রতিটি ছবিতে যে রাস্তা দেখছি,
যে মানুষ দেখছি, যে দোকান দেখছি তাতে পলাশমারির চিহ্নমাত্র নেই।দোকানের গায়ে লেখা
আছে 'পলাশমারি,খুলনা' ,কিন্তু এই কি সেই গ্রাম?বহুক্ষণ ধরে মেলাবার চেষ্টা করছিলাম
সেই ছবিগুলোকে,যা ছাপাবার অতীত।
'পুরোনো দিন ফেরেনা কোনোদিন..' জানি,বুঝিও। এও জানি যে ঐসব ছবি যখন
সৃষ্টি হয়েছিল মনের মধ্যে তখন তারা এসব ছবির প্রস্তুতিপীঠ ছিল না।নিজের বিন্যাসেই
তারা সৃষ্ট। আত্মসম্পূর্ণ।এতদিনে পলাশমারিকে ' 'বাহির' মনে হচ্ছে।এতদিন আসলে ঘরেই
ছিলাম।এই 'ঘরের' পলাশমারি আর 'বাহির'রের পলাশমারি একই জায়গায় হয় কেমন করে?
'আমার বাড়ির কাছে আরশীনগরের' কথা মনে পড়ে যায়।এই ঘর আর বাহিরের
মাঝে,আমার আর আমার আরশীনগরে থাকা পড়শীর মাঝে একাকার হয়ে আছে সব।এদের মধ্যে একীভবন
নয় ,বিরুদ্ধতা নয়-এক দুর্লঙ্ঘ্য যোগাযোগের সামঞ্জস্য খুঁজে ফেরাই কি ভ্রমণ নয়?সে
ভ্রমণেই তো প্রকান্ড 'আমি'কে দেখার চেষ্টা। যে পড়শী ছুঁলে যমযাতনা যায়..
বিঃ দ্রঃ দিদাকে আর ছবিগুলো দেখাই নি, বয়েস হয়েছে,বেড়াবার ধকল যদি
নিতে না পারেন? পাঠককেও দেখালাম না-কারণ, আগের ছবিগুলো তো দেখাবার সুযোগ নেই,কেবল
এ ছবিগুলো দেখলে সামঞ্জস্য খোঁজার ভ্রমণ তো সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়।এ আমার কাছেই
থাক।একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে।
No comments:
Post a Comment