সে পথ
পৃথিবীর চেনা ছকের বাইরে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া লেগে গিয়েছে অনেক আগেই। তাই
শুভাকাঙ্খীরা নিষেধ করলেন। কিন্তু তখন অজানা জগতের অপ্রতিরোধ্য ডাকে পথে নেমে
পড়েছি। ফেরার উপায় নেই। হৃষীকেশ থেকে ঘনশালী –পুরো পথটাই “অল ওয়েদার রোড” তৈরির
নামে খোঁড়াখুঁড়ি করে ভয়াবহ করে তোলা হয়েছে। সুতরাং যাত্রাপথের ধকল সামলাতে
ঘনশালীতে এক রাত বিশ্রাম নিতে হল।
ভোরের
ভিলাঙ্গনা নদীতে সূর্যের প্রথম আলো সব ক্লান্তি মুছে দিল। অপার সে সৌন্দর্য্য
ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। শান্ত সুবৃহৎ এক বিশ্বরূপের সামনে যেন দেবতাত্মার আলোর
অঞ্জলি। চঞ্চল জলের শব্দের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছে একটি দুধশাদা বক।
কোথাও কোন শব্দ নেই। শেরপা রানাজী এসে তাড়া দিলেন ‘নাস্তা কর লিজিয়ে সাব। জলদি
নিকলনা পড়েগা। বহোৎ লম্বা চলনা হ্যায়...’
দই আর
পনীর পরোটা দিয়ে একটু ভারী জলখাবার সেরে নিয়ে পথে নামলাম। মুখ-হাত ভিজিয়ে নিলাম
নদীর ঠান্ডা জলে। সত্যিই নদী যেন কথা বলতে শুরু করেছে আমাদের সাথে ‘মার্গং
তাবচ্ছৃণু কথয়স্ত্বং প্রয়াণানুরূপং সন্দেশং মে...’ মেঘ-মাখা আলো আর চির-গাছের
কথোপকথন নিয়ে চলেছে অন্য এক যুগে, অন্য এক দৃশ্যলোকে।
নদীর
সৈকত ছুঁয়ে এগিয়ে চলা এই পায়ে-চলা পথকে কখনো পথ বলাই মুশকিল। লতাগুল্মে ঢাকা
সংকীর্ণ পথের রেখাকেই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মাঝে মাঝেই ভঙ্গুর পাথরে ভয়াবহ ধ্বস।
রাণাজী অভিজ্ঞ চোখে এমন সাবলীলভাবে পথ খুঁজে খুঁজে এগিয়ে যাচ্ছেন যেন প্রশস্ত কোন
রাজপথে চলেছেন। চলতে চলতে অবিরাম কথা বলে চলেছেন ‘এই পথের দৈর্ঘ্য অনেকটা কম। তবে
ভালুকের উপদ্রব হয় প্রায়ই। নেহাতই যদি হামলা করে, তাহলে কিন্তু ঠিক যেভাবে বলেছি
সেভাবে টিফিনবক্স দূরে ছুঁড়ে ফেলবেন। তারপরেই হামলা চালালে হাতের লাঠিটা কিভাবে
চালাবেন, তা তো বলেই দিয়েছি’ রাণাজী হাসেন ‘এই রুট টুকু আসলে ওয়ার্ম আপ।
নদী-জঙ্গল-পাহাড়ের সাথে একটু কথা বলে নেওয়ার জন্য। আসল ট্রেকিং শুরু হবে গুট্টু
থেকে। নদী-জঙ্গল-আকাশ-ফুল-ফল-পাহাড় সবকিছুর সৌন্দর্য্যের একটু একটু করে দেবত্বে
উত্তরণ হবে’।
পাথরের
খন্ড দিয়ে সাজানো এক পাহাড়ী ঘরের আধো-অন্ধকারে আমরা রাজমার তরকারি আর মান্ডোয়ার
রুটি খেতে খেতে ট্রেকিং রুটে অবিশ্বাস্য সব দুর্ঘটনার মুখ থেকে অলৌকিক ভাবে ফিরে
আসার গল্প শুনি। দোকানদার রাণাজীর কার্যকলাপের সাথে বহুদিন ধরে পরিচিত। তিনিই
রাণাজীর দেবোত্তর সেসব কীর্তির কথা বলেন- চরম অসাধ্যসাধন করে নিজের জীবনের
সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে কিভাবে বাঁচিয়েছেন মানুষদের। রাণাজী চূড়ান্ত উদাসীন নিঃস্পৃহ
মুখে আচারের কৌটো এগিয়ে দিতে দিতে বলেন ‘এসব নিতান্তই স্বাভাবিক এবং আবশ্যিক
কর্তব্য’ অল্প হাসেন ‘ছাড়ুন ওসব কথা। এখানে কাছেই এক নৃসিংহ দেবতার মন্দিরে আজ
পুজো। কচি পাঁঠা বলি হবে প্রচুর। সন্ধেয় পাঁঠার মাংস আর লাচ্চা পরোটা চলবে নাকি?
দেশী মদিরা সহযোগে...’
‘আমি
নিরামিষাশী। মদ্যপানও করি না। কাজেই লাচ্চা পরোটা ছাড়া কিছুই চলবে না...’
‘বাঙালী
হয়ে এসব খান না?’ রাণাজী আশ্চর্য্য হন ‘তাহলে বাসি রাজমার তরকারি দিয়েই লাচ্চা
পরোটা খেতে হবে আপনাকে। যাই হোক, পুজোর আচার-অনুষ্ঠান তো দেখবেন চলুন। তিব্বতী
শামানিজম-বৌদ্ধতন্ত্র-শাক্ত-শৈব সব রীতিনীতির অদ্ভুত মিশেল’। ভীড়ের মধ্য মিশে অন্য
এক অতীতে যেন ডুবে গেলাম।
পরদিন
কাকভোরে ঘুট্টু থেকে রীহ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ভোরের প্রথম আলোয় সে অপার্থিব
সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত। মহাকালের জপের মালা থেকে বিচ্ছিন্ন এক আশ্চর্য সময়ের মধ্যে
দিয়ে যেন চলেছি। অত্যন্ত খাড়াই পথ। বারবার পা হড়কে যাচ্ছে। পথশ্রমে শরীরে সামান্য
ঘাম ফুটে উঠতেই হিমশীতল হাওয়া এসে শুষে নিচ্ছে। মাত্র দশ কিলোমিটার এই পথ যেন আর
ফুরোতেই চায় না। সাড়ে এগারোটায় এসে পড়লাম দেবলিং নদীর উপত্যকায়। দেওলাং গ্রামের
বুরাংশ আর চির পাইন ঢাকা পথ আরো খাড়াই। রাণাজীর কোন ক্লান্তি নেই। আমি মাঝে মাঝে
পাথরখন্ডে বসে জিরিয়ে নিচ্ছি। গ্লুকোজের জল খেয়ে খেয়ে বোতল প্রায় খালি হয়ে এসেছে।
‘এই
রীহ গ্রামেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতে হবে’ রাণাজী হাত ধুয়ে ছোট্ট একটা দো’চালার
সামনে বসে পড়লেন ‘ রুটি, শাক, দই আর পাঁচমিশেলী ডাল ছাড়া কিছু কিন্তু নেই’।
‘এতেই
যথেষ্ট’ প্রবল ক্ষুধার তাড়নায় আমি দ্রুত খাওয়া শুরু করি। গৃহস্বামী হাসিমুখে দইয়ে
সামান্য চিনি মিশিয়ে বললেন ‘বাঙালি মানুষ যখন শেষপাতে একটু মিষ্টি দই না হলে তো
চলবে না। এখানকার ডাল, শাক নিশ্চয় মুখে রুচছে না?’
আমি
সলজ্জে মাথা নাড়ি ‘না না, রান্না খুব ভাল হয়েছে। এই দুর্গমে, এমন শীতে এ খাবার
অমৃততুল্য। গৃহস্থের মঙ্গল হোক’
হঠাৎ
আকাশে মেঘ-কুয়াশার আগম হওয়ায় রোদের তেজ অন্তর্হিত। তীব্র হিমেল হাওয়া এসে কাঁপুনি
ধরিয়ে দিচ্ছে শরীরে। রাণাজী সন্দিগ্ধ চোখে একবার তাকালেন ‘গাঙ্গি এখনো প্রায় চার
ঘন্টার রাস্তা। পথ বেশ চড়াই। যাবেন? নাকি রাত্রিটা এখানেই কাটাবেন?’
‘না
না, চলুন’ আমি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে হাতে লাঠিটা তুলে নিই।
একের
পর এক বুগিয়াল পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের ভিতর দিয়ে যেন এক অলৌকিক দেশে চলেছি।
বৌদ্ধদর্শনের শম্ভালা নাকি হিন্দুদর্শনের ব্রহ্মলোক? লম্বা উলের পোশাক পরা
মেষপালকেরা ভগবান যীশুর মতো মুখ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। সন্ধ্যা নামছে
দিব্যমন্ডলে। পৃথিবীর সন্ধ্যার যে অমন অপরূপ রূপ হয়, তা এই ভয়ঙ্কর দুর্গম পথে না
এলে বোঝা যেত না। বাতাসের শব্দ, অচেনা পাখির ডাক, নদীর শব্দ সবার উপর এক শান্ত সুরের
তুলি বুলিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যা। আর সন্ধের প্রথম আঁধারের প্রলেপ পড়তেই পবিত্রতম আকাশে
শরীর বিছিয়ে দিল উজ্জ্বল আকাশগঙ্গা। এত অল্প আঁধারেই ধনুনক্ষত্রমন্ডল, হংসপুচ্ছ,
জ্যেষ্ঠা আর একের পর নীহারিকা যে এমন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, ভাবতে পারি নি। কেউ
যেন আড়ালে বসে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে চলেছেন- “ জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে/
নিশীথের পানে গহনে হয়েছে হারা/ অঙ্গুলি তুলি’ তারাগুলি অনিমেষে/ মাভৈঃ বলিয়া নীরবে
দিতেছে সাড়া/... ম্লান দিবসের শেষের কুসুম তুলে/ একূল হইতে নবজীবনের কূলে/ চলেছি
আমার যাত্রা করিতে সারা/ ... হে মোর সন্ধ্যা, যাহা কিছু ছিল সাথে/ রাখিনু তোমার
অঞ্চলতলে ঢাকি’/ আঁধারের সাথী, তোমার করুণ হাতে/ বাঁধিয়া দিলাম তোমার হাতের রাখী’।
‘রাণাজী,
আপনি কি বাংলা জানেন নাকি? কেউ যেন এখানে অন্ধকারে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিল!’
‘নেহি
সাব। ওরকম অনেক শব্দ এখানে অনেকেই শুনতে পায়। কেউ উপনিষদের শ্লোক শোনে, কেউ নিখিল
ব্যানার্জির সেতার শোনে। কেউ আবার অনেক কিছু দেখতেও পায়-
নন্দলাল-গগনেন্দ্রনাথ-রোয়েরিখ-রেমব্রান্টের ছবির আলো, অজন্তা-আলতামিরার আলো,
কৌষিতকি উপনিষদের আলো। সাব, আমি লেখাপড়া তেমন শিখি নি। তাও অভিযাত্রীদের কথা শুনে
এই দেখুন, ডায়েরিতে কত কিছু লিখে রেখেছি’
ডায়েরির
পাতা উলটে আমি তাজ্জব হয়ে যাই। একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাই। ঘোর থেকে তুললেন
গৃহস্বামী রাওয়াত সাহেব ‘রাতের খাওয়া কিন্তু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। আটটার মধ্যে
নৈশভোজ সেরে ফেলাই এখানের রেওয়াজ। তাই অনুরোধ করছি...’
‘হ্যাঁ,
প্লিজ চলুন’
সাড়ে
আট হাজার ফুট উঁচু সরাইখানায় বসে অড়হর ডাল আর মান্ডোয়ার রুটি খেতে খেতে আমাদের
গল্প চলতে থাকে ‘রাণাজী, হিমালয়ের নির্জন এলাকায় তো অনেক ঘুরেছেন। কখনো কোন অজানা
অচেনা জীবের দেখা পান নি? অলৌকিক কিছু ঘটে নি?’
‘অনেক
বার। উত্তরকাশীর কাছে নাগদেবতার মন্দির থেকে কিছুটা দূরে অদ্ভুত এক জানোয়ার
দেখেছিলাম। শেয়াল জাতীয় প্রাণী, আকারে বেশ বড়। অনেককেই বর্ণনা করেছি, কেউ চিনতে
পারে নি। কুমায়ুঁতে তারিক্ষেতের কাছে, কাসারদেবীর কাছে, শীতলাক্ষেতের কাছে চুড়েলের
ডাক শুনেছি কয়েকবার। পিন্ডারিক গ্লেসিয়ারের কাছে অন্ধকার রাতে এক তেকোনা মাথাওয়ালা
অতিকায় জীবের দেখা পেয়েছিলাম। সবাই শুনে বলেছে, ইয়েতি। পরে চামোলীর পাথরনাচুনিতেও
তার দেখা পেয়েছি অস্পষ্ট’ দেশী মদিরার ঘোরে রাণাজীর কথা এরপর অন্য জগতে প্রবেশ
করল। কথার তোড়ে ঢুকতে থাকল গাড়ওয়ালী, নেপালী, তিব্বতী শব্দ। গৃহস্বামী এবং
গৃহকর্ত্রী এসে না থামালে মুশকিল ছিল। দূরের জঙ্গলে চিতাবাঘের ডাক শুনতে শুনতে
আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন
সকালে পাহাড়ী আলু-পালং –এর তরকারি আর পরোটা খেয়ে রওনা দিলাম খারসালির পথে। রাণাজীর
গল্প শুরু হল ‘ এই রাস্তায়ও অনেক কিছু দেখার আছে। ঘন্টা তিনেক যাওয়ার পর বাঁদিকে
একটা চমৎকার রাস্তা ঘুরে যাবে সহস্রতালের দিকে। অনেক ফুল-ফলের গাছ, সুন্দর
বুগিয়াল, অনেক ঝর্ণা- সবকিছু দেখতে দেখতে আমরা ঘুরে যাব ডানদিকে’
দুপুর
দেড়টা নাগাদ আমরা পৌঁছালাম এক ওক গাছের জঙ্গলে। এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে
হবে। রাতে থাকার ক্যাম্পও এখানেই। সামনে ভয়ঙ্কর রাস্তা। সন্ধেয় থাকারও ব্যবস্থা
নেই।
আগের
দু’রাত পাহাড়ী গ্রামের পাথুরে ঘরে কাটিয়েছি। জীবনে এই প্রথম বার খোলা আকাশের নীচে
তাঁবুতে থাকতে হবে। তাও আবার সাড়ে ন’হাজার ফুট উঁচু দুর্গম পাহাড়ের ওক গাছের
জঙ্গলে। রাণাজী হাসেন ‘প্রথম বার ট্রেকিং করতে এসে আপনার পারফর্ম্যান্স কিন্তু খুব
ভাল। আমরা সময়ের আগে আগে চলেছি’ রান্নার আয়োজন করতে করতে হাসলেন ‘পাশেই রাওয়াতজীর
ট্রেকিং-এর দল তিন খানা তাঁবু ফেলেছে। এই অঞ্চলে যেহেতু রাতে ভল্লুক, চিতাবাঘ,
ময়াল সাপ ইত্যাদি তাঁবুর বাইরে ঘোরাফেরা করে, রাতে মূত্রত্যাগ করতে হলে এই চার
তাঁবুর ক্যাম্পফায়ারের কাছাকাছিই... লাঠি আর টর্চ নিয়ে বেরোবেন... আর আমাকে
জাগাবেন প্রত্যেকবার...’
পাশের
ক্যাম্পের লোকেদের সাথে আলাপ-পরিচয় সেরে এসে তাড়াতাড়িই রাতের খাওয়া সেরে নিলাম
আমরা। একটু পরেই রাণাজী দেশী মদিরার টানে পাশের তাঁবুতে চলে গেলেন। আমি একটু
বিরক্ত হলাম। রাণাজীর সম্পর্কে আমার বন্ধু ট্রেকারদের মুখে বিস্তর প্রশংসা শুনে
তাঁর সাথে একা পথে বেরিয়েছি। তিনি নাকি নিজের জীবন বারবার তুচ্ছ করে দেবতার মতো
বাঁচিয়েছেন সবাইকে। তাঁর চেয়ে ভাল গাইড নাকি গোটা হিমালয়ে মিলবে না। কিন্তু এখন যে
অন্য দৃশ্য দেখছি। এখানে অতিরিক্ত শীত এবং কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ। তার ওপর কাল
চ্যালেঞ্জিং ট্রেকিং। তুষারপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে ঘুমিয়ে কোথায়
শরীরটা চাঙ্গা করে নিতে হবে, অথচ তাঁর দেখাই নেই। কাল কখন বেরোনো, সকালে কখন কি
খাওয়া হবে- কিছু ঠিক না করে তিনি চূড়ান্ত অপেশাদারী মনোভাব দেখাতে শুরু করেছেন।
মাতাল হয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় তাঁবুতে ফিরলেন। কোন কথা না বলে শুয়ে পড়লেন।
শেষরাতে
ঝড়-বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। রাণাজী অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। ঘুম আর আসছে না। খারাপ
আবহাওয়া চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে। দূর থেকে ভেসে আসা হিমালয়ান হুইস্লিং থ্রাসের ডাক
শুনতে শুনতে কত কি চিন্তা মাথায় এল। চোখের সামনে দিয়ে যেন হিমালয়ের পথে যুগ যুগ
ধরে অনন্ত ক্যারাভান চলতে লাগল। অপরিচিত আলোর পথযাত্রীদল। ছ’টা নাগাদ উঠে পাশের
অস্থায়ী টয়লেটে ফ্রেশ হয়ে আসা গেল। সকালে উঠে রাণাজী একটু পেশাদার হয়েছেন। গরম চা
আর গরম জলের ব্যবস্থা করেছেন। ‘একটু পরে ডিম-পাঁউরুটি, কলা আর ছাতুর সরবৎ দিয়ে
ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা ট্রেকিং শুরু করব। পাশের ওই বারোজনের দলটার সাথে
একসাথেই এগোতে হবে এবার। সামনে রাস্তা একটু খারাপ আছে। তার ওপর হালকা বরফ পড়ে গলতে
শুরু করেছে’
একটু
এগিয়েই খারসালির তীব্র জলস্রোত। গভীরতা কোথায় কম-বেশী বোঝা মুশকিল। বিশাল বিশাল
পাখরখন্ড যেমন ছড়িয়ে আছে, তেমনই স্রোতের বেগ। পা সামান্য হড়কালেই পাথরে ঠুকে বা
স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়ে লীলাসংবরণ হতে পারে। রানাজী শক্ত হাতে ধরে ধরে দীর্ঘক্ষণে
পার করে দিলেন। এরপর ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত খাড়াই রাস্তা। ভালুক এবং
চিতাবাঘের দেখা মেলে এ রাস্তায় প্রায়ই। দল বেঁধে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি আমরা।
বেয়ারা হৃদপিন্ড আর পরিশ্রান্ত ফুসফুসকে একটু শান্ত করতে মাঝে মাঝে বসে জিরিয়ে
নিতে হচ্ছে। জুনিপার আর সিলভার বার্চে ভরা ঘন বনের পথ। রাণাজী আর অন্যদলের গাইডের
অনর্গল বকবক শুনতে শুনতে এগিয়ে চলেছি ‘এইটি হল ভুমকোদার গুহা’ ঘন গুল্মলতায় ঢাকা
এক গুহা। পাশেই কয়েক ঘর মানুষের একটা ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম। আমরা এগিয়ে চলেছি। যোগীন গ্রুপের
তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গগুলি মাভৈঃ বলে আমাদের দৃশ্যপটে সঙ্গ দিয়ে চলেছে। আর একটু
এগিয়ে তামকুন্ড গুহার সামনে আমরা মধ্যাহ্নভোজে বসে পড়লুম।
খারসালি
থেকে শাহী পনীর আর পরোটা আনা হয়েছিল। সেগুলো গরম করে সামান্য এপ্রিকটের আচার
সহযোগে খাওয়া জমে গেল। কিন্তু আবহাওয়া উত্তরোত্তর খারাপ হয়েই চলেছে। কুয়াশা বাড়ছে।
এক বেলাতেই দলের অনেকে সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত। আর পায়ে এবং কোমরে ব্যথা তো
আছেই। রাণাজী মালপত্তর গোছাতে গোছাতে বললেন ‘আবহাওয়া খারাপ থাকলে মানুষের শরীরও
খারাপ হয়। কিন্তু আরো কয়েক কিলোমিটার না এগোলে আজ চলবে না। আস্তে আস্তে এগোব।
দু-আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে’।
দু’ঘন্টা
পরে সেই পথের শেষে ভেদীখড়্গ নামক পাহাড়ী গ্রামে ক্যাম্প করলাম আমরা। বৃষ্টি হয় নি,
কিন্তু মেঘ-কুয়াশায় ভিজে উঠেছে সব। বিকেল চারটেতেই সন্ধে নেমে এসেছে ঝুপ করে। কাঠকুটো
জোগাড় করে দ্রুত আগুন জ্বালানো হল। আর সে আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে গল্প। রাত যত
বাড়ছে, ঠান্ডা হাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে, আর প্রত্যেকের জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার
গল্পের আমেজে জমে উঠছে আড্ডা। আলু-বেগুন পোড়া আর মাখন-মাখানো তন্দূরী রুটির দিব্য
স্বাদে কখন যে নৈশভোজ শেষ হয়ে গেল, বুঝলামই না। রাণাজী হঠাৎ তাড়া দিলেন ‘আজ একটু
তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়তে হবে। কাল সকালে খুব চ্যালেঞ্জিং ট্রেকিং’। দশটার মধ্যেই
ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা।
পরদিন
সকালে উঠে যা দেখলাম, তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলব না। সূর্যোদয়ের আগে
প্রভাততরলজ্যোতির মধ্যে তুষারপাত হচ্ছে। যেন স্বর্গের সুধা ঢেলে দিচ্ছে কেউ। গুঁড়ো
গুঁড়ো বরফের পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় আধঘন্টারও বেশী সময় ধরে চলল সেই পবিত্র
তুষারপাত। তারপর সেই বর্ফিলি হাওয়ার ভেতর আমরা ক্যাম্পফায়ার করে চা খেলুম,
স্যান্ডউইচ খেলুম, মিষ্টি খেলুম। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে তারপর সেই বরফমাখা পথে এগিয়ে
চলা। মিহি নুনের মতো বরফ ছড়িয়ে আছে পথে। পায়ের জুতোর চাপে অল্প অল্প গলছে। পা হড়কে
যাবার ভয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে হচ্ছে। সামনে পথ আরো খাড়াই। কাজেই রিস্ক না নিয়ে
এবার দড়ি ধরে এগোনো শুরু হল। লাইনে সবার আগে অভিজ্ঞ দু’জন শেরপা- রাণাজী আর
কুকরেতিজী।
খাতলিং
হিমবাহের সেই বরফ-ঢাকা অপার সৌন্দর্য্য ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। যেদিকে
তাকাই, শুধুই বরফ। আর এক দিব্য আলোর মায়াময় প্রদীপ আকাশে জ্বেলে রেখেছে সূর্য।
দলের সবাই শিশুর মতো আনন্দে বরফ নিয়ে খেলাধুলো শুরু করেছে। আইস স্কেটিং, স্নো বল
ছোঁড়াছুঁড়ি, ঘন ঘন সেলফি তোলা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। ভিলাঙ্গনা নদীর উৎস এই খাতলিং
হিমবাহ। জীবনে এই প্রথমবার কোন হিমবাহ দেখছি, কোন নদীর উৎস দেখছি। অপার মুগ্ধতায়
কোথা দিয়ে যে সময় বয়ে চলেছে, বুঝতে পারছি না। রাণাজী হুঁশিয়ারি দিলেন ‘ অনেক
হয়েছে, আর নয়। এবার অবরোহণের পালা শুরু করতে হবে। এই হিমবাহ পুরো ঘুরে ঘুরে দেখতে
দু’দিন লেগে যাবে। আর অতটা সময় এখানে থাকতে গেলে বরফে জমে জীবন্ত জীবাশ্ম হয়ে
যাবেন। চলুন শিগগির। স্বর্গসুখে বেশীক্ষণ থাকতে নেই’
বেশ
খানিকটা পথ নেমে এসে দুপুর দু’টো নাগাদ মধ্যাহ্নভোজ সারলাম আমরা। তারপর সন্ধের
আগেই ভেদীখড়্গে পৌঁছে ক্যাম্পে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। পায়ের আর কোমরের ব্যথায়
ততক্ষণে কাবু হয়ে পড়েছে দলের অর্ধেক সদস্য। মানুষের সংসারের অভিমুখে আরো নামতে
থাকি আর ব্যথা বাড়তে থাকে।
No comments:
Post a Comment