“তোমায়
একটা দারুন জিনিস দেখাব আজ। ফ্রেশ মাল , কালই এসেছে ………ও খোকাদা , আপনি বাজারটা সেরে আসুন, ও ততক্ষন এখানে
থাকুক।“
বাচ্চু
কাকুর কথাটা শুনেই প্রমাদ গুনেছিলেন আমার মামা। বাচ্চু কাকু অতিশয় ধুরন্ধর দোকানী।
সে জানে একবার ছলে বলে কৌশলে আমায় দোকানে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। মামার রীতিমত
কালঘাম ছুটে যাবে সেখান থেকে আমায় খালি হাতে বের করতে। তাই মামা তড়িঘড়ি করে একটু শক্ত গলায় বলেছিলেন – না,না, একদম
না , এই সেদিন দুটো ব্যাট (আসলে সস্তার টেনিস র্যাকেট) আরও এক গাদা কিসব কেনা হল।
তোর জন্য তো এই রাস্তা দিয়ে আর হাঁটা যাবেনা রে বাচ্চু, একদম মাথা খাবিনা ওর।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিলেন – এই চল শীগগির , বেশি বেশি করলে কিন্তু
মাকে বলে দেবো - এসে নিয়ে চলে যাবে, বুঝবি মজা তখন।
আমি করুণ চোখে মামার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম – আমি কি বলেছি কিনে দিতে ? এরকম করো
কেন? আমি শুধু একবার দেখব জিনিসটা কি?
বলেই মামার হাত ছাড়িয়ে এক লাফে সেঁধিয়ে গেছিলাম বাচ্চু কাকুর দোকানের মধ্যে।
বাচ্চু কাকুও কাঁধে হাত দিয়ে চট করে লুকিয়ে ফেলেছিল আমায়। মামা নিস্ফল চোখে আগুন
ঝরিয়ে একবার বাচ্চু কাকু আর একবার আমার
দিকে তাকিয়ে হন হন করে সোজা বাজারের দিকে হাঁটা দিয়েছিল।
এইটা
সেই সময়ের কথা যখন প্রযুক্তির উৎপাতে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হওয়া শুরু হয়নি। মফঃস্বল তো
বটেই খাস কলকাতার বুকেও মানুষের হাতে নির্ভেজাল আড্ডা মারার মতন সময় ছিল। রেডিওতে আকাশবাণী
কলকাতা শোনা যেত , অ্যান্টেনাতে কাকেরা হুজ্জতি করত , শীত কালে পিকনিকে যাওয়ার সময়ে
সাদা বাক্সে বাপুজি কেক , ডিম আর কলা পাওয়া যেত। চৈত্র সেল বা পুজোর আগে আগে মধ্যবিত্ত
হৃদয় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দশ টাকা কম করার জন্য
দোকানীর সাথে দেদার ঝগড়া করে শেষে গজ গজ করতে
করতে ফুচকাওয়ালা কে বলত – ঝালটা একটু বেশি করে দাও না বাবা , তোমাদের জ্বালায় আর পারিনা।
দিনগুলো আসলে দৌড়ানোর বদলে গোঁফে তা দিয়ে গদাইলস্করি চালে ধীর লয়ে চলত।
এইটা
সেই সময়ের কথা আমি যখন সদ্য বুঝতে শিখেছি লেডিস সিটের সামনে কোন মহিলা আসলে , আমার
উঠে দাঁড়ানো উচিৎ। তবে ওঠার আগে আড়চোখে সেই মহিলার দিকে চকিতে তাকানো আরও বেশি করে
উচিৎ। অঙ্কের খাতায় সংখ্যার বদলে বেশি থাকত বিভিন্ন ম্যাগাজিন থেকে কেটে রাখা নায়িকাদের
খোলামেলা ছবি। তখন আমি গ্রীষ্মের দুপুর গুলোতে কে সি নাগের মুণ্ডপাত করি আর দিন গুনি
কবে পড়বে গরমের ছুটি। কারণ গরমের ছুটি মানেই বাড়ির নাগপাশ থেকে মুক্ত এবং মামার বাড়িতে
প্রায় মাস খানেকের জন্য আমার অস্থায়ী রাজধানী গড়ে তুলে সেখান থেকেই রাজকার্য চালানো
শুরু। নৈহাটি রেল স্টেশন থেকে নেমে মিনিট পনেরো
হাঁটলেই আমার গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। সাহিত্যিক সমরেশ বসুর বাড়ি থেকে আমার মামার বাড়ি
ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব। এক সময়কার প্রভাবশালী মিত্র জমিদারদের নামে আমাদের পাড়ার নাম মিত্র পাড়া। সেই জমিদারদের নাচঘর , নাটমন্দির আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে
পাড়ার এদিকে সেদিকে। ক্লাশ এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিয়ে সবে গেড়ে বসেছি সিংহাসনে।
দাদু ,দিদা, মামা , মামীমা , দুই মামাতো বোনকে নিয়ে আমার তখন ভরা সংসার। মোবাইলের আগমন
না ঘটার কারনে মা বাবা পৌঁছানর সংবাদটুকু পেয়েই খুশী থাকতেন,তার বেশি মাথা ঘামানোর
ইচ্ছে বা প্রয়োজন কোনটাই তাঁদের ছিলনা। সকালে মামার সাথে বাজার যাওয়া, দুপুরে দাদুর
কাছে ইংরেজি আর অঙ্ক করা ছাড়া কোন কিছুই নিয়মমাফিক করার নিয়ম ছিলনা। ইতিমধ্যে একদিন
সকালে রেডিওর খবরে শোনা গেল – অমর্ত্য সেন
বলে কেউ একজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অমর্ত্য সেন বা নোবেল এই কোনটার সম্পর্কেই
খুব একটা পরিষ্কার ধারণা তখন আমার ছিলনা। তবে বড়সড় একটা ঘটনা ভদ্রলোক ঘটিয়েছেন সেটা
বুঝেছিলাম , কারণ দাদু দুপুরের পড়া থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিল যেটা ছিল হ্যালির ধূমকেতুর
চেয়েও বিরল ঘটনা। মনে আছে সেদিন আমরা তিন ভাই বোনে সারা দুপুর ছাদের ঘরে লুকিয়ে আনন্দলোক
পড়েছিলাম। আশ্চর্য মোহময়ী ছিল সেইসব রুপোর নদীর মত দুপুরের হাতছানি।
এত
সব সুখের আয়োজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমায় যেটা আকর্ষণ করত সেটা হল বাচ্চু স্টোর্স।
মিত্র পাড়ার মূল রাস্তার দুদিকে সাধারণ আটপৌরে বাড়ি। সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে পাঁচশো
মিটার গেলেই পড়বে একটা বড়সড় চৌমাথা যার বাঁ দিকে রেল বাজার ,ডানদিকে গরিফা আর সোজা গঙ্গার ঘাট। এই মোড়ের মাথাতেই হল
বাচ্চু স্টোর্স। যার আসল নাম নিউ ভ্যারাইটি স্টোর্স, মালিকে ডাক নাম বাচ্চু – তাই আসল
নামটা ধীরে ধীরে কালের নিয়মে সবাই ভুলেই গেছে। বাচ্চু এবং তার স্টোর দুটোই সেই সময়ে
এমন বিখ্যাত ছিল যে গোটা মিত্র পাড়ার লোক কোন অচেনা লোককে বাড়ির ঠিকানা বলার সময় বলতো
– ওই তো, ষ্টেশনের বাইরে এসে যেকোনো রিক্সাকে বলবেন- বাচ্চু স্টোর্স , পৌঁছে যাবেন।
বাচ্চু কাকু মাঝবয়েসী - গালে বসন্তের দাগ
, মাথায় পাতলা হয়ে আসা চুল নিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে দোকানের সামনে একটা
টুল পেতে বসে থাকত। মফঃস্বলের ছোট পাড়ায় সবাই
মোটামুটি মুখ চেনা। তাই বিক্রিবাটা আর বাঙালির আড্ডা দুটোই চলত হাতে হাত ধরে। আমার আসল আগ্রহ ছিল দোকানটার মধ্যে। সে এক আশ্চর্য
দুনিয়া। বাচ্চুর দোকান সত্যিকারেরই ভ্যারাইটি স্টোর্স। বিশ্বকাপে আজেন্টিনা , জার্মানি
, ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের ছবি দেওয়া ছোট কার্ড , ক্রিকেট ব্যাট, সাদাকালো চৌখুপি করা
সস্তার ফুটবল, দেশ বিদেশের পুতুল , প্লাস্টিকের ঢাল তলোয়ার , হি ম্যান তলোয়ার , কোডাক
ক্যামেরার রিল, ভিসিআর ক্যাসেট, এয়ার গান , ক্যাপ বন্দুক , বিদেশী ঘড়ি, সস্তা রংচঙে
পাথরের আংটি , নিকেলের বা সোনার জল করা গয়না থেকে শুরু করে লাল নীল রঙের লজেন্স , হজমী
গুলি এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় নুন , চিনি , আটা , ময়দা বিস্কুট অব্দি পাওয়া যেত। আমার পৃথিবীটা তখন আশ্চর্য রকমের ছোট আর শান্ত
ছিল। দৈনন্দিনের বাইরে তুচ্ছ কোন ঘটনাও জাগিয়ে তুলত বিস্ময় , শান্ত দিঘির জলে ঢিল ফেলার
মত আলোড়িত হত চিন্তারা। কৌতূহলেরা অস্থির ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো ঘরের আনাচে কানাচে।
রোদ ঝলমলে দিন বা মন খারাপের বিকেলকে দু চোখ দিয়ে শুষে নিতাম , এখনকার মতন ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজস্বীর সাথে তাদের কয়েদ করে
রেখে দেওয়ার তাগিদটা ছিলনা যে তখন। আমার সেই ছোট্ট পৃথিবীতে বাচ্চুর দোকান ছিল স্বপ্নের
কারখানা। কত নির্জন দুপুরে বাকিরা ঘুমিয়ে পড়লে
আমি লুকিয়ে চলে যেতাম সেই কারখানায় , দেখতাম
আলো আধারির মধ্যে , পাঁচমেশালি গন্ধের মধ্যে সাজানো আছে
অপার ঐশ্বর্য। দেশ বিদেশের পতাকা , নির্জন সমুদ্রতট বা অচেনা বিদেশিনীর ছবি
, কোমর দোলানো সল্পবসনা পুতুল আরও কত কি।
এরকমই
একদিন মামার সাথে সকালে বাজার যাওয়ার সময় , ‘ফ্রেশ মাল’ এর লোভে দেখা পাই বিশাল এক নীল তিমির। সমুদ্রের সাদা ফেনা আর নীলচে
জলের মাঝখানে দৃপ্ত ভঙ্গীতে জলকেলি করছে ভারি মিষ্টি চেহারার এক দানব। ফুরফুর করে জল
ছাড়ছে মাথার ওপর থেকে। না, কোন সিনেমা দেখিনি , কারণ টেলিভিশনের দুনিয়াটা তখনও রঙিন
হয়ে ওঠেনি মফস্বলে। যেটা দেখেছিলাম সেটা একটা মস্ত বড় রঙিন ছবি। সেটা যে বিদেশ থেকে
আনা বোঝাই যাই। বাচ্চু কাকুর কলকাতা পোর্ট এলাকায় কিছু জানাশোনা ছিল , তাই সেখান থেকে
প্রায়ই নানা বিদেশি জিনিস আনত সে লুকিয়ে চুড়িয়ে। এই ছবিটাও সেরকম ভাবেই আনা নিশ্চিত।
বেশ বড় পোস্টারের সাইজের ছবি, দুটো তিমি মাছ মাঝ সমুদ্রের মধ্যে খেলাধুলো করছে। সবচেয়ে
মজার ব্যাপার হল – ছবিটাকে আড়াআড়ি ভাবে ঘোরালে তিমি দুটোর পজিশান চেঞ্জ হয়ে যায় আর
জলের রঙও নীল থেকে হাল্কা সবজে হয়ে যায়। থ্রি ডি ছবি কাকে বলে তখন আমি কেন কেউই বিশেষ
জানত না আর জানতাম না বলেই অবাক বিস্ময়ে দম বন্ধ হয়ে গেছিল আমার। সমস্ত দুনিয়া একদিকে আর ওই নীল তিমি দুটো অন্যদিকে।
সেইদিনই জীবনে প্রথমবার
আমি লোভের স্বাদ পেয়েছিলাম। তিমির আশ্চর্য কার্যকলাপে বিভোর আমি বুঝেছিলাম ওদের না
পাওয়া অব্দি এই জীবনে আমার শান্তি নেই। দ্রুত ছকে নিলাম পরবর্তী পদক্ষেপ এবং সেই মত
লাগাতার তিনদিন বিভিন্ন ভাবে বায়না করে আগে দাদু দিদাকে বাগে এনেছিলাম, দ্বিতীয় ধাপে খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার হুমকিতে মামাও বেকায়দায় পড়ে গিয়ে
অবশেষে তিমি যুগলকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
“সুপ্রভাত প্রিয় যাত্রীরা, কায়কোরা ‘হোয়েল ওয়াচের’ পক্ষ
থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি জন্টি। আগামী তিন ঘণ্টা আমি আপনাদের সাথে থাকব এবং
আমরা একসাথে দেখব কায়কোরার অসামান্য সামুদ্রিক প্রাণী বৈচিত্র , যার মধ্যে মূল আকর্ষণ নীল তিমি ও স্পার্ম তিমি ......
আমি বসে আছি দুধ সাদা মাঝারি সাইজের মোটর বোটে। বোটটা
জল কেটে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে সমুদ্রের মাঝখানে। একটু আগেই ওয়্যারলেসে আমাদের
বোটের চালককে জানানো হয়েছে সাত নটিক্যাল মাইল দূরে দেখা গেছে একটা অতিকায় পূর্ণ
বয়স্ক স্পার্ম তিমি আর দুটো নীল তিমি। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সেই অভিমুখে যাত্রা
শুরু করলাম আমরা।
কায়কোরা নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের শুরুর দিকের
এক ক্ষুদ্র জনপদ। জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন হাজার। ডলফিন, তিন ধরণের তিমি ছাড়াও
নানা বিচিত্র সামুদ্রিক প্রাণী বৈচিত্র্যর জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে এই পুঁচকে
শহরের। কায়কোরার বিস্তারিত বিবরণে যাওয়া আগে নিউজিল্যান্ড আর আমার সম্পর্কে কয়েকটা
কথা বলে নিই। গত কয়েক বছর ধরে কর্মসূত্রে আমার আস্তানা নিউজিল্যান্ডের রাজধানী
ওয়েলিংটন শহরে। নিউজিল্যান্ড তিনটে বড় দ্বীপ আর অসংখ্য ছোটোখাটো দ্বীপের সমষ্টি। বড়
দ্বীপগুলো হল নর্থ আইল্যান্ড (North Island), সাউথ আইল্যান্ড(South Island) আর স্টুয়ার্ট আইল্যান্ড
(Stuart Island)। ওয়েলিংটন নর্থ আইল্যান্ডের দক্ষিণে একদম শেষ বিন্দু , এরপরেই
শুরু হয়ে যায় সাউথ আইল্যান্ড – মাঝখানে একফালি সমুদ্র। ক্রাইস্টচার্চ ছাড়া সাউথ
আইল্যান্ডে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শহর না থাকলেও
পর্যটনের দিক থেকে এনার জুড়ি মেলা ভার। স্টুয়ার্ট আইল্যান্ডে বিশেষ জনবসতি
নেই তবে এখানেও পর্যটকদের বেশ ভিড় লেগে থাকে কারণ বছরের কিছু বিশেষ সময়ে এই
দ্বীপের আকাশ থেকে দেখা যায় অসামান্য অরোরা অস্ট্রালিস, যা কিনা পৃথিবীর বুক থেকে
দেখতে পাওয়া প্রকৃতির আশ্চর্যতম ঘটনা গুলোর মধ্যে অন্যতম।
কায়কোরা সাউথ আইল্যান্ডের প্রথম শহর পিক্টন থেকে
মাত্র দেড়শ কিলোমিটার। যারা ওয়েলিংটন থেকে সাউথ আইল্যান্ডে ঘুরতে বা কাজে যায়
তাঁরা সাধারণত ইন্টার আইল্যান্ডার বলে একটা ফেরি সার্ভিস করেই যাতায়াত করে, তবে
হাতে সময় কম থাকলে বিমান পরিষেবাও আছে। কায়কোরার নাম নিউজিল্যান্ডে বিখ্যাত মূলত
দু ধরণের মাছের জন্য , আদতে যেদুটো কোনটাই মাছ নয় , একটা তিমি আর অন্যটা ক্রে ফিশ
বা অতিকায় চিংড়ি। গোটা শহরটা দৈর্ঘ্য , প্রস্থে খুব বেশি হলে কলকাতার যাদবপুর থেকে
পার্ক সার্কাস অব্দি হবে – যার এক দিকে পান্না সবুজ রঙের এক শান্ত সমাহিত সমুদ্র
আর অন্য দিকে বরফের মুকুটে সাজানো পাহাড়ের চূড়া। সাউথ আইল্যান্ড দক্ষিণ মেরুর অনেক
কাছাকাছি বলে এখানে স্নো লাইন বা হিমরেখা অনেক নিচে , তাই খুব সামান্য উচ্চতার
পাহাড় বা অনেক সময় উঁচু টিলার মাথাগুলোও বরফের চুম্বনের স্বাদ গায়ে মাখতে পারে।
আমাদের দেশের মতন শুধু নগাধিরাজ হিমালয় ছাড়া আর বিশেষ কারো যেমন সেই সৌভাগ্য হয়না –
এখানে ঘটনাটা সেরকম নয়।
কায়কোরার বর্ণনা দিতে গেলে যেটা না বললেই নয় সেটা হল
কোস্টাল প্যাসিফিক রেল। শহরের ঠিক মধ্যে দিয়ে বুক চিরে গেছে এই ঐতিহাসিক রেল লাইন।
ন্যারোগেজ এই রেল লাইন দিয়ে কায়কোরার ওপর দিয়ে সারা দিনে একবার একটাই ট্রেন যায় –
বাকি সময়টা প্রিয় কবির কবিতার মতন সুস্বাদু এই রেলপথ নিঝুম হয়ে পড়ে থাকে কোন দূর
দেশ থেকে আগত সমঝদার প্রেমিকের চোখের জন্য , অথবা নির্লজ্জের মত দেখে সবুজ ফেনিল
জলের সাথে উদার আকাশের সঙ্গম। এক কথায়
বলতে গেলে সমুদ্র পাহাড় নিবিড় বনানী আর মায়াবি রেল লাইনে মোড়া এই শহর যেন কোন এক
সদ্য ঋতুমতী কিশোরীর কল্পনার প্রেমিক -
যার শরীর জুড়ে রয়েছে মোলায়েম জীবনের নিশ্চিত আশ্রয়।
তিমি দেখার জন্য এখানে অনেকগুলো হোয়েল ওয়াচ সংস্থা
আছে – যার মধ্যে কোনটা সরাসরি সরকারী আবার কোনটা সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত। সকাল
সাড়ে আটটা থেকে শুরু হয়ে প্রতি দু ঘণ্টায় একটা কুড়ি সিটের মোটর বোট জেটি থেকে ছেড়ে
মাঝ সমুদ্রে পাড়ি দেয় তিমি দর্শনের
উদ্দেশ্যে।।প্রতিটা বোটে আলট্রাসনিক সাউন্ড গান থাকে যার সাহায্যে আগে থেকে জেনে
নেওয়া যায় তিমির অবস্থান, এছাড়াও মাথার ওপরে ঘুরতে থাকে একাধিক হেলিকপ্টার , তিমির
তৈরি করা জলের আলোড়ন লক্ষ্য করলেই পাইলট বোটের চালককে জানিয়ে দেয় নির্দিষ্ট জিপিএস
লোকেশান – শুরু হয়ে যায় তিমি অভিযান।
আমি বোটে ওঠার মিনিট কুড়ির মধ্যে জানতে পারলাম আজকে ভাগ্য
সুপ্রসন্ন। এক জায়গায় তিন খানা তিমি স্পট করা গেছে। আমি তিমি নিয়ে অত উত্তেজিত ছিলাম
না কারণ ততক্ষনে আমার বেশ আলাপ জমে গেছে বোটের সাথে সাথে চলা ডলফিনের ঝাঁকের সাথে।
জন্টি এক বাপ বেটিকে দেখিয়ে বলল – এরা নাকি মেজাজ ভালো থাকলে লাফিয়ে হাত থেকে খাবার
খেয়ে যায়। কন্যা ডলফিন আমায় দেখে একটু গদগদ
হলেও বাপের চোখের চাহনি ঠিক আমার ভালো লাগলো না। বুঝলাম আমার এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো।
ইতিমধ্যে বোটের মুখও ঘুরে গেছে, আমরা এগিয়ে চললাম নীল গ্রহের বৃহত্তম মেরুদণ্ডীকে ক্যামেরা
দিয়ে শিকার করার উদ্দেশ্যে। যত এগোতে লাগলাম আমার বুকে কেমন যেন গুড়গুড়ে
আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মনে পড়ে যাচ্ছে বহুদিন আগে দেখা দুই তিমি দম্পতির কথা। আমার
প্রথম কৈশোরকে বিস্মিত করে দেওয়া সেই নানা রঙের আশ্চর্য ছবিটার কথা। কত অলস দুপুর
, বিনিদ্র রাত্রি কাটিয়েছি ওদের দিকে তাকিয়ে , ভেবেছি – একবার , একবার যদি কোনভাবে
যেতে পারি ছবিতে দেখা নীল সমুদ্রের মাঝখানে , দেখতে পাই আসল তিমির নেতাগিরি। আজকে
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সাক্ষী হব সেই মুহূর্তের – যেখানে এক কল্পনা ছুঁয়ে ফেলবে
বাস্তবকে। নগ্ন সপ্নসুন্দরী হয়ে যাবে ফ্যাকাশে রোজকার শয্যাসঙ্গিনী। এতো অতি
আনন্দের মুহূর্ত – কিন্তু তাও কেন বুক কাঁপছে আমার? কেন মনে হচ্ছে ক্ষমতার জোড়ে
আমি কিনে নিচ্ছি এক চোদ্দ বছরের কিশোরের মুগ্ধতাকে , তার আনন্দে মাখামাখি চকচকে
দুই চোখকে। আমার কোন অধিকার নেই সেই ভোরের সূর্যের মত স্নিগ্ধ কিন্তু উজ্জ্বল
ভালোলাগাকে সাধারণ ভোঁতা অভিজ্ঞতা দিয়ে মাপার। আমি অপরাধ করতে যাচ্ছি – সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
চারিদিকে
অকূল জলরাশি। আজকে একটু গরম আছে , আকাশও পরিষ্কার। তাই আজকের দিন হোয়েল ওয়াচিং এর জন্য
আদর্শ। আমার সাথের স্প্যানিশ সুন্দরী একে একে করে তার অপ্রয়োজনীয় জামাকাপড় খুলে ফেলে
বোটের ছাতেই রোদ পোহাতে বসল এবং আমায়ও জোর করে টেনে নিয়ে চলল , আমি নাকি মুড অফ করে
বসে আছি । সে আমায় জিজ্ঞেস করলো – তুমি এরকম করছ কেন? দেখো সবাই কত এক্সাইটেড , তোমার
শরীর ঠিক আছে তো? সি সিকনেস হয়নি তো? আমি সামান্য হেসে বললাম – আমি একদম ঠিক আছি ,
তুমি এগোও আমি আসছি । সে চলে গেলে কিছুটা নিজের মনেই বললাম – সিকনেস যদি কোথাও থেকে
থাকে তাহলে সেটা আছে আমার মাথার মধ্যে মামনি, মধ্যবিত্ত বাঙালির যে কত জ্বালা সে আর
তুমি কি বুঝবে ?
আচমকা বোটটা দুলে উঠল, আর সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল , অনেকের
বিস্মিত অভিব্যক্তি কানে এল - দেয়ার ইট ইস …… ও মাই গড , ইটস সো ফাকিং বিগ। এক
বুক ভরা শ্বাস নিয়ে উঠে এলাম বোটের ডেকে। সবাই এখানে এসে গেছে , হাতে বড় বড় টেলিস্কোপিক ক্যামেরা, মোবাইলের রেকর্ডার সবার অন
করে রাখা। জন্টি আমার কাছে এসে দাঁড়াল , বলল আর ইউ ওকে ম্যান ? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ
বলতেই , পেশাদার গলায় বলল – এবার তোমার ডানদিকে তাকাও , দেখো জলের ওপরে ফোয়ারা উঠছে
, এক্ষুনি দেখতে পাবে তিমিটাকে , ইটস আ বিগ
ওয়ান। আমি তাকিয়ে দেখলাম – ঠিক ছবিতে দেখা ফোয়ারা উঠছে , আশেপাশের জলে আলোড়ন। সহসা
জল বিদীর্ণ করে নিজের অতিকায় শরীর মোচড়ালেন তিমি বাবাজী । ত্রিশ ফুট দূর থেকে পরিষ্কার
দেখতে পেলাম ধূসর রঙের জলদানবকে। নিঃসন্দেহে ‘ইট ইস ফাকিং বিগ’ , এতো বিশাল জীব স্বচক্ষে
দেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। তিমি এবার ফুরফুরিয়ে জল ছাড়া শুরু করলো , জন্টি বলল – এরকম সাত থেকে আট
বার জল ছাড়ার পড়েই আবার অতল জলে ডুব দেবেন তিনি। গড়ে একটা নীল তিমি বা স্পার্ম তিমি তাদের
জীবনের আশি শতাংশ সময় কাটায় জলের নিচে। এছাড়াও তাদের মাথার ওজন , খাদ্যাভ্যাস নিয়ে
অনেক জ্ঞানের কথা বলছিল সে , আমার কানে কিছুই ঢুকছিলনা। আমি খালি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
তাকিয়ে ছিলাম তিমির দিকে। এই তাহলে তিমি? যাদের দেখতে এতদূর থেকে ছুটে আসা? কই
আমার তো মনে হচ্ছেনা , আহা কি দেখিলাম জন্ম জন্মাতরেও ভুলিবনা ......দুররর !!!
কোথায় সেই ছবিতে দেখা কল্পনা মাখানো বলিষ্ঠ তিমি আর কোথায় এই সত্যিকারের বাস্তব
তিমি যাদের দেখলে শুধু চোখ ভরে কিন্তু মন অপূর্ণ থেকে যায়। এই তিমির স্থায়িত্ব
বড়োজোর মোবাইলের দামী ক্যামেরায় বা মেমোরি কার্ডে থাকবে , ফেসবুকে উঠে কিছু লোকের লাইক
পাবে , শেয়ার হবে। কিন্তু আমার নিজস্ব যে দুটো তিমি আছে , তারা তো আমার সবকটা
নিউরোনে বাসা বেঁধে বসে আছে। তাদের হাত থেকে আমার এতো সহজে নিস্তার নেই। বুক থেকে
একটা পাথর নেমে গেল, ফিরে এল উৎফুল্ল ভাব। লোকজনকে হেসে হেসে বললাম – কি তোমাদের
ছবি তুলে দেবো? এই দিকে রোদের অ্যাঙ্গেলটা ভালো আছে ... একজন বলল , কেন তুমি ছবি
তুলবেনা? আমি উদার ভাবে বললাম – এর থেকে অনেক ভালো তিমির ছবি আছে আমার কাছে। আমার
আর দরকার নেই ।
তিমি শেষ বার জল ছেড়ে ডুব মারার প্রস্তুতি নিল ,
চারিদিকে জল ছিটিয়ে সে লেজ দেখিয়ে চলে গেল তার নিজের পৃথিবীতে। তিমি দেখা গেছে
,সবাই নিশ্চিন্ত।জন্টিও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে
জামা খুলে পেশিবহুল চেহারা দেখিয়ে লোকজনকে (বিশেষত মেয়েদের) বোঝাতে লাগল
এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি , আরও কি কি দেখবো
আমরা......
আমি ওর কার্যকলাপ দেখে একটু মুচকি হাসলাম। মোটরবোট
আবার স্পীড তুলেছে । আমরা জলে সাদা ফেনা তুলে যাচ্ছি অন্য কিছু দেখতে। সল্পবসনা
সুন্দরীরা শরীর মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। মনে মনে বললাম – এতো আয়োজন , এতো
সমারোহ ...সেই তো বাপু সবাই মিলে গো-হারা হারলি আমার লুঙ্গি পড়া ভুঁড়িওয়ালা বাচ্চু
কাকুর কাছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে দুকলি গানও গেয়ে ফেললাম – তুম জিও
হাজারো সাল ......
আড়চোখে দেখালাম স্প্যানিশ সুন্দরী অবাক হয়ে আমার দিকে
তাকিয়ে আছে , পাগল টাগল ভাবছে বোধহয়। ভাবুক , ইংরেজিতে একটা কথা আছে না - হু কেয়ারস!!
No comments:
Post a Comment