Friday, May 31, 2019

জুলেখা-কে – অনির্বাণ ভট্টাচার্য





প্রিয় জুলেখা,
কেমন আছ? যদিও উত্তর পাব না জেনেই এতসব লেখা। অবান্তর। ভীষণ। আর জানোই তো উদাসীন পড়শিকে নিয়ে আমার ঘর, আমাদের ঘর। বেড়ানো। ভ্রমণ।
কোথায় যাচ্ছি? যাবে? জানতে চাও? একটা বাড়ি আছে জানো। আকাশে ছড়ানো মেঘ। তার কাছাকাছি। মহীনের ঘোড়া ঘাসেদের সঙ্গে বাঁধা। চোখে কথা। ও আমাকে নিয়ে যাবে। তোমাকেও। সেই বাড়িতে। একটা পুরনো লোহার সিঁড়ি। নীচে ঘাস, বালি, শ্যাওলা। ওপরে আকাশ। মাঝে নস্টালজিয়ার ধাপ। সাবধানে এসো। শাড়ি? লং স্কার্ট? সাবধানে জুলেখা। আমার হাত অপারগ। পাশে থাকতে পারব। ধরতে পারব না। একেবারেই। ওপরে এসো। ছাদ। ডালের বড়ি। এর ওর পার্টিশন। শ্যাওলা, শরিক। আমরা ওসব মানব না। পাঁচিলে গোল গোল ফাঁক। ওপর থেকে নিচে লুকিয়ে দেখার জাদুবাস্তব। ক্যালাইডোস্কোপ। আমি অতীতকে দেখি।  হারবার্ট সরকার যেমন বুকিকে  দেখত। থেমে গেলে কেন? গোটা ছাদ ঘোরো। বৃষ্টি আসে না। এই সময় কোনও বৃষ্টি আসে না। চুল বড় কর না কেন? ভাসতে ইচ্ছে করে না, বলো? অবশ্য আমি তো অপারগ, বলেছি ...। ঠিক, এমনটাই ভাল। ক্যাসাব্লাঙ্কা। ইংগ্রিড। তুমি। আর আমি একটার পর একটা খেলা হেরে যাওয়া বোগার্ট। হামফ্রে বোগার্ট। আর ওঁর ফেলে দেওয়া সিগার। জুলেখা, তোমার গালের কাছে জোনাকি। ওপরে তারা। স্বাতী। অরুন্ধতী। জুলেখা, তোমার ওই নামে কোনও বান্ধবী আছে? এক একটা তারা খসার আওয়াজ আমাদের ভ্রমণে ট্রেনের হুইসলের মতো। আমরা ওপরের বার্থ থেকে দুজন দুজনের হাতে নিষিদ্ধ ধরাধরির ভেতর ফেলে আসব পরিত্যক্ত পাহাড়ি স্টেশন, ফেলে আসা পুরনো কথা, জীবন নষ্ট, জন্মের আগের ওপারের জীবন। আমাদের ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে। একটু এপাশে এসো। ছাদের একপাশে আমাদের অশথ গাছটা শরীর ছুঁয়ে আছে। ওকে ধরো। বোঝো। ফিল করো। আমি। ওটাই আমি। গত জন্মের আমি। শুধু আকারে একটু বড় হয়ে গেছি। কিছু একটা সমস্যার এদিক ওদিকে। নামছ? দেখো। একটা পুরনো গন্ধ আছে। ওপরে নতুন করা অ্যাসবেস্টস। তাপ্পি মারা জীবন আমার। এসো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা গিয়ে প্রথমটা ছেড়ে বাঁ পাশেই আমার ঘর। কী দেখছ? হ্যাঁ, এমনই। ভেঙে পড়েছে। আলনা, আলমারি, ওয়াল-র‍্যাক, নেতাজী সুভাষের ফ্রেম – সব। পেরেকের জীবন, মেঝে। জুলেখা, সাবধানে। পায়ে কিছু বিঁধলে আমি কষ্ট পেতে পারি, তুলতে পারব না। আমি, অপারগ। একটা তালা বন্ধ ঘর আছে। তার ওপাশে পুরনো স্টুডিও, ছোটবেলার একানড়ে আসার স্মৃতিময় ভেনেসীয় জানলা, আর সেই গন্ধটা। তোমার সাফোকেশন, আমার শাল্মলী। বেড়ে ওঠা। উঁকি মারা ডালে, পাতায় মরে যাওয়া বেড়াল, কুকুর, মানুষ। সিলিং-এর ব্যবধান। মানুষ আসলে দোলে না। পৃথিবী দোলে। মানুষ জাস্ট অবস্থান পাল্টে নেয়। আমরা উদ্বন্ধন বলি। এতসব মরবিডিটির মাঝে আমাদের ভ্রমণ, জুলেখা। একটা বড় বাড়ি যখন ভেঙে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়, তার ওদিকটা আমাদের ছোটদের দেখা হয় না। আমরা এদিকটা দেখেই বাকিটা ভেবে নিই। কড়ি, বরগা, ইট – আসলে কেউ পুরনো হয় না। মানুষ পুরনো হয়। রাত্রের কোনও এক গোপন সমনামবুলিজমে তাকে সরিয়ে ফেলতে হয় এদিক থেকে ওদিকে, চাঙর মাটি থেকে নামাতে হয়, চাকরি বাইরের জেলায়, ট্রান্সফার, ছেলেমেয়ের স্কুল, সব পাল্টে দিতে হয় তাকে। মনে হয়, জোর করে কিছু মানুষকে একটা সোনার খাঁচায় পুরে মজা দেখছিল কেউ। এতদিন সেই খাঁচাটা ভেঙেছে। খাঁচা, তবু, আমার তো বাড়ি ছিল। ওটাই আমার বাড়ি ছিল। তোমাকে চেনাতে চেনাতে আমার এই বাড়ি, ভ্রমণ সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে জুলেখা। একটা রাতের টিভি আমাকে মুলহল্যান্ড ড্রাইভ চালিয়ে চলে গেছে। আমি নাইন্টিজের অ্যাড, আজহারউদ্দীনের গ্ল্যান্স, হেমন্তের গান আর অদ্ভুত কিছু দৃশ্যের মাঝে দেখছি স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের জায়গা বদল। জিগস পাজল। কোনটা সত্যি, কোনটা স্বপ্ন বোঝা যাচ্ছে না। স্বপ্ন-ভ্রমণ? অনেকটা নিচে নেমে এসছ তুমি। প্রায় নিচে। একটা উঠোন ছিল। দেখতে পাচ্ছ? ঈশান কোণে একটা লেবুগাছ। ওখানে একটা বেড়াল থাকত। অসুস্থ। কবে মরে গেল জানি না। উঠোনটা আর নেই। তুমি যা দেখছ, তা সলে তারাগুলো থেকে আসা আলো, জুলেখা। আলোটা দেখছ। তারাগুলো, জীবনগুলো, নেই। দাদুর মাথা লেগে দেওয়ালে একটা তেলের তাগ। কোথায় গেল? ওপরে পুরনো মিটার বক্স। ছোট বড় কুলুঙ্গি। আছে, আবার নেই। রং করার পর মনে হয় অন্য বাড়ি। শুধু ওই আয়ত, গোল, রম্বসগুলোকে দেখে একটা ব্যথা হচ্ছে বুকে। তোমাকে বললে হাত দেবে। চিন্তিত হবে। আমি হাত রাখতে পারব না। বুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে পারব না তোমার আঙুল, চামড়া, নখ, গন্ধ। জুলেখা, আমি অপারগ। হাঁটতে হাঁটতে বাইরে এসছ। একটা রোয়াক। রক। আর আমার রক শুনলেই সেই পাখিটার কথা মনে পড়ে। আসলে ছিল, এখনও আছে। একটা বড় রক পাখি আমাদের ডানায় বসিয়ে আকাশের ওপার দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নিচে টাইম ল্যাপ্সে পাল্টে যাচ্ছে দেওয়াল লিখন, আত্মহত্যার চেষ্টা, জন্ম, মৃত্যু, পেডিগ্রি। সেই রক। লোডশেডিং হলেই ওখানে বয়স্কারা বসতেন। তুমি বসলে? সাবধানে। সিমেন্ট খসে যাচ্ছে। একটা বড় গর্তে চকলেট বোম ফাটিয়েছিল কেউ। ওই জায়গাটা আছে। আসলে ফাটলগুলো থাকে। অপরিবর্তনীয়। সম্পর্কগুলো ঘেঁটে যায়। আশেপাশের বাড়িগুলোর ভেতর সেই পুরনো চেহারা। কোনওটা আগে, কোনওটা পরে। সবার ভাগ একদিন আসবেই, তাই না? তখন অন্য কোনও বাড়িতে তোমাকে নিয়ে হাঁটবে আমার মতো অন্য কোনও অস্তিত্বহীন। বাড়িগুলোর ওপরে ছোট ছোট চৌকো। নম্বর লেখা। ওটা গুনে গুনে স্কুল যেতাম, ফিরতাম। যার দিকে বেশি চৌকো, সেই জিতবে। হার, জিত। কে জিতল, হারল? জুলেখা, আমরা তো হারলাম, কে জিতল বলো তো? কেউ না ...
ফিরে এসো। ট্রেন। লোকাল ট্রেন। মেইন লাইনের স্টেশনের ধারের বাড়ি, গল্প, ছাদে শুকনো শাড়ি, চুল, মোছার জন্য উদগ্রীব গামছা, চিরুনি, নারীত্ব। ওদের নিয়ে অন্য এক গল্প। আমি জানি না। অন্য কেউ। তুমি তাদের কাছে যেও।
আমাকে একা থাকতে দাও। আমার ঘর ভাঙছে। কেউ লেখার কথা, ছাদের কথা, পোষা খরগোশটার কথা জিজ্ঞেস করবে না। তোমার সঙ্গে দেখা হবে? ক্যাসাব্লাঙ্কা বলছিলাম না? শীত আসছে। অল্প কুয়াশা। একটা প্লেন। দেখা হবে।
‘মে বি নট টুডে, মে বি নট টুমরো, বাট সুন ... অ্যান্ড ফর দ্য রেস্ট অফ ইওর লাইফ’


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম