Friday, May 31, 2019

শান্তিনিকেতনের কলাভবন রিয়া চক্রবর্তী





মাস দুয়েক আগেই ঘুরে এলাম আমার তীর্থ স্থান শান্তিনিকেতন থেকে। আবারও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে এলাম। কলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ইতিহাস কী? যেহেতু আঁকার প্রতি আমার ভালোলাগা আকাশছোঁয়া তাই  যা কিছু জানলাম সেই নিয়েই আমার এই লেখা।
১৯২০ সালে নন্দলাল বসু স্থায়ী ভাবে কলাভবনের যোগদান করেন। তখন তাঁর ছাত্র ছিলেন মাত্র চারজন। অর্ধেন্দু প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরাচাঁদ দুগার, কৃষ্ণকিঙ্কর ঘোষ এবং ধীরেন কৃষ্ণ দেববর্মণ। কলাভবনের অধ্যক্ষ হয়ে নন্দলাল বসু দুভাবে শিক্ষাদান  করেছেন। প্রথমত একজন সৃজনশীল, সদা অনুসন্ধিৎসু শিল্পী হিসেবে আর দ্বিতীয়ত একজন অসাধারণ শিক্ষক হিসেবে। তিনি যখন কলা ভবনের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন শিক্ষক ছিলেন তাঁকে নিয়ে তিনজন। তিনি, অসিতকুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ কর। ১৯২৩ সালে অসিত কুমার কলাভবন ছেড়ে জয়পুরের মহারাজের কলাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষতা করতে চলে গেলেন। এর পরে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, অন্নদাপ্রসাদ মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, ভি. আর. চিত্রা, বিনায়ক মাসোজি, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমে ক্রমে কলাভবনে যোগ দেন। এই প্রথম পর্বের ছাত্রদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নন্দলাল বসু গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি। তিনি মুলত তিনটি ধারায় তাঁর শিক্ষানীতি পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। ১/ মৌলিকতা ২/প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং ৩/ পরম্পরা। নন্দলাল বসুর মতে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গাছপালা, ফুল, ফল, আকাশ,  মাটি যেমন প্রকৃতির অঙ্গ। তেমনই সকল জীবজন্তু, মানুষ ও এই প্রকৃতির অংশ। তাদের চলাফেরা, তাদের জীবনযাপন, তাদের স্বভাব, গঠন, বর্ণ, তাদের অন্তরকে বোঝার চেষ্টা করাই হল প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ।
কলাভবনের সূচনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এই শিল্পকেন্দ্রটিকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। সেই কারনেই শিল্পী নন্দলাল বসু বিভিন্ন কালের বিচিত্র শিল্পী মনের সঙ্গে পরিচয়ের পথ উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেও তাঁর ছবিতে মিশর, আসিরিয়া, চীন ও জাপানের চিত্র থেকে উপাদান গ্রহণ করেছেন। নন্দলাল বসু কিন্তু বিমূর্ত চিত্রকলার বিরোধী ছিলেন। তিনি চিত্রকলাকে রূপকলা হিসেবেই মানতেন এবং এই রূপকলার প্রাণশক্তি মনে করতেন তার ডিজাইন বা অলংকরণ করার গুণকে। তিনি মনে করতেন তিনটি ধারার সংযোগের মাধ্যমে শিল্পশিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। সেগুলো হল বাস্তব উদ্দিপনা, চিত্রের বাঁধন, এবং আঙ্গিকের নৈপুন্য। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নন্দলাল বসু যেমন তাঁর ছাত্রদের আগ্রহী করে তুলেছেন ঠিক ততখানি করেননি বর্ণের জগতের সঙ্গে।
শান্তিনিকেতনের দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তর, খোয়াই মাঠ,  মাঠে বিচরণরত মোষ, সাঁওতালী নারী পুরুষ,শিশু  তালগাছের সারি, হাটের লোকজন, মালপত্র  বোঝাই গরুরগাড়ি, গাছপালা, ফুল, পাখি সব কিছুই সযত্নে অঙ্কিত হতে থাকলো নন্দলাল ও তাঁর ছাত্রদের তুলিতে। নন্দলাল নিজে অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে শান্তিনিকেতনের আশেপাশের জীবনকে ভালোবেসে তুলিতে ধরে রাখার কাজ সহজ এবং মহান আদর্শে ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। নন্দলাল বসু কেবল ভাবনাতেই নয়, নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ সব চিত্র। তিনি তাঁর শান্তিনিকেতনের জীবনকে দুটি দিকে সম্প্রসারিত করেন। প্রথম দিক ছিলো গ্রাফিক্স আর দ্বিতীয় দিক ছিলো ফ্রেস্কো। প্রচলিত রীতিকে কাগজে বা কাপড়ে রং তুলিতে ছবি আঁকার পাশাপাশি এই দুই বিপরীত ধর্মী ছবির ভাষাকে তিনি সারা ভারতের চিত্রশিক্ষার জগতে অগ্রনী ভূমিকা নেন।
গত শতাব্দীর শেষ দুই দশক ধরে সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র অন্নদাপ্রসাদ বাগচী এবং তাঁর সহযোগীরা মিলিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা আর্ট সোসাইটি লিথোগ্রাফ পদ্ধতিতে ছবি ছেপে এবং তা প্রচার কতো তখনকার বাঙালি জনজীবনে অনেকখানি প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু নব্য বঙ্গীয় কলাশীল্পের আন্দোলনে এই ছাপানো ছবির গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছিল দেরিতে।  কালক্রমে নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ  কর শান্তনিকেতনের কলা ভবনে ছাপাই ছবির কাজ শুরু করেন।  নন্দলাল তাঁর প্রথম লিথোগ্রাফ আঁকলেন 'সাঁওতাল নৃত্য'। ১৯২৫ সালে নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপান ও চীন ভ্রমণ করেন এবং এর ফলে কলাভবন আরও সমৃদ্ধ হয়। নন্দলাল বসু ভ্রমণ সুত্রে প্রচুর জাপানি উড প্রিন্ট, উড ব্লক, নিয়ে এসেছিলেন। কেবলমাত্র নন্দলাল বসুই নন তাঁর ছাত্ররাও কেউ কেউ এই ছবি ছাপাই এর প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ড্রাই পয়েন্ট, উডকাট, লিনোকাট, এচিং ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। কলাভবনের ছাত্র মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তকে তাঁর আগ্রহের জন্য উইলিয়াম পিয়ারসন এচিং এর মেশিন ও যন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে এনে।
তবে যে দুজন শিল্পী ছাপাই ছবির মধ্য দিয়ে ওই সময়ে  নিজেদের কাজের পরিচয় রেখেছেন তারা হলেন মুকুল চন্দ্র দে এবং রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। মুকুলচন্দ্র দে আমেরিকাতে গিয়ে জে. ব্লান্ডিং স্লোয়ানের কাছে এচিং শিখে তারপর ইংল্যান্ডে যান। লন্ডনের স্লেড স্কুলে কিছুকাল শিক্ষারত থেকে পরে ভর্তি হন রয়েল কলেজ অফ আর্ট এ। তারপর কিছুদিন কাজ করেন ফ্রাঙ্ক শর্টের স্টুডিও তে।এইভাবে দীর্ঘ সাত বছর তিনি বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি এচিং ও ড্রাই পয়েন্টের মাধ্যমে সুক্ষতর রেখার কখনও সীমিত প্রয়োগে আবার কখনো বিপুল ও জটিল ব্যবহারে তিনি তার ছবিগুলো এঁকেছেন। জল রঙে তিনি মুলত অবনীন্দ্রনাথের ধারাতেই সাহিত্য নির্ভর ছবি এঁকেছেন। আবার কখনো আদর্শ গ্রামের ছবিও এঁকেছেন। কিন্তু তাঁর ছাপাই ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে সাধারণ কর্মরত মানুষ, বিশেষ করে সাঁওতালদের জীবন।
সুরেন্দ্রনাথ করও ছাপাই এর ছবির যোগ্য শিক্ষক হয়ে ওঠার জন্য রবীন্দ্রনাথের সাথে লন্ডন গিয়েছিলেন ১৯২৪ সালে। সেখান থেকে তিনি লিথোগ্রাফিতে বিশেষ শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন। রমেন্দ্রনাথ কলাভবনে তাঁর কাছে লিথোগ্রাফি এবং ফরাসী ইহুদী শিক্ষিকা আঁদ্রে কার্পেলের কাছে উডকাট বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সালে লন্ডনে গিয়ে বিশিষ্ট শিল্পী ম্যুরহেড বোন এর কাছে এচিং, ড্রাই পয়েন্ট, ও অ্যাকোয়াটিন্ট শেখেন দুই বছর। চিত্রকলার বিভিন্ন দিক যেমন জলরং, টেম্পেরা ও তেলরং ইত্যাদিতে পারদর্শী হলেও রমেন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের অনেকটাই ব্যয় করেন গ্রাফিক্সের বিভিন্ন পদ্ধতিতে ছবি এঁকে ও ছাপিয়ে। উডকাট, এচিং, অ্যাকোয়াটিন্ট, ড্রাই পয়েন্ট, লিথোগ্রাফ, লিনোকাট এইসব শিল্পে সমান পারদর্শী ছিলেন। শান্তনিকেতনে নন্দলাল বসুর ছাত্র হিসেবে তিনি অবনীন্দ্র পরম্পরাকেই বহন করেছেন। কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে  দ্বায়িত্ব গ্রহণের পরে অনেক কৃতী ছাত্র তিনি তৈরি করেছিলেন। শফিউদ্দিন আহমেদ, হরেন্দ্রনারায়ন দাসের মতো গ্রাফিক্সের শিল্পী ছিলেন তাঁরই ছাত্র। শফিউদ্দিনের কাছ থেকে পরবর্তীতে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে উডকাট শিখেছিলেন তাঁর ছাত্র বিখ্যাত গ্রাফিক্স শিল্পী সোমনাথ হোর। এই কারনেই বলা চলে শান্তনিকেতনের কলাভবনের ছাপাই ছবির ধারা এখনো বয়ে চলেছে বাংলার নানান দক্ষ শিল্পির মধ্য দিয়ে।
নতুন নতুন. পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিখ্যাত ছবির মাধ্যমে কলাভবনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা নন্দলাল বসু আর তাঁর দুই বিখ্যাত ছাত্র বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর বেইজের হাত ধরে। এই তিন মহান শিল্পী লিথোগ্রাফ, উডকাট, উড এনগ্রেভিং, লিনোকাট, এচিং, ড্রাই পয়েন্টে ও অন্যান্য রীতিবহির্ভূত পদ্ধতিতে ছবি ছাপেন। তাঁরা নানা রকম উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল শক্তির. পরিচয় দিয়েছেন, যার তুলনা ভারতের ছাপাই ছবির ইতিহাসে বিরল। এমনই এক পরীক্ষা হিসাবে  নন্দলাল বসু ও রামকিঙ্কর বেইজ সিমেন্টের ব্লকের সাহায্যে ছবিও ছাপিয়েছিলেন। নন্দলাল বসুর উডকাট আব্দুল গফ্ফর খান, মহাত্মা গান্ধী, ড্রাই পয়েন্ট পাইন বন, কোপাই নদী, ও অর্ধ শায়িত. অর্জুন বিখ্যাত। তাঁর এচিং গীতরত বাউল, ও ছাগল বিখ্যাত। এছাড়া গ্রাফিক্সের কাজে তাঁর বিভিন্ন সাফল্যের সাক্ষ্য রেখে গেছেন।
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও উডকাট, লিনোকাট, এচিং, ড্রাই পয়েন্টে তাঁর নিজস্ব শিল্প বোধ ও নৈপুন্যে সমৃদ্ধ এমন অনেক ছাপাই ছবির সাক্ষর রেখে গেছেন যা আলোচনার দাবী রাখে। তবে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ এঁদের থেকে আরও স্বতন্ত্র। ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম, ছাপাই ছবি ছাড়াও উডকাট শিল্পে তিনি এমন এক বলিষ্ঠ স্বাক্ষর রেখে গেছেন যার তুলনা অন্য কোন শিল্পীর কাজে মেলে না। শান্তনিকেতনে তিনি তাঁর নিজস্ব মূল্যে, আলোছায়ার রূপবন্ধনে, তাঁর প্রাণশক্তিতে নির্মাণ  করে গেছেন একের পর এক মহান শিল্প। রামকিঙ্কর বেইজ ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এই দুই মহীরুহের হাত ধরে ছাপাই ছবিতে শান্তনিকেতন পৌঁছে গেছে সাম্প্রতিক চিত্রকলার জগতে। তাঁদের পরে কলাভবনে ছাপাই ছবির চর্চা বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে নতুন শিল্পীদের মাধ্যমে আবার সেই ধারা উজ্জীবিত হয়েছে।



No comments:

Post a Comment

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম