Friday, May 31, 2019

‘আসা-যাওয়ায় পথের ধারে...’ মনোনীতা চক্রবর্তী






ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে দেয় চিল... ' তারপরও থেকে থেকে যায় চোখ,নাক-মুখ,ঠোঁটখোলা গলে-গলে পড়া জীবন বা তারই মতো কিছু!  মায়া-মায়া-মায়া...  ঘনমায়ায় মুছেই গেল চির অভিমানী 'মায়া' -স্বয়ং!  তাতে কী! তাতে বুনন আর বিনুনি। পানকৌড়ি,  তুমি বেলেমাটির গাছ বানিয়েছিলে, মনে পড়ে!? টংঘর, শালবন, তোমার গানের খাতার মভ কালারের ঠোঁট আঁকা পৃষ্ঠা, ঈষৎ গোলাপি তাতে... আসলে, উলটো পোশাকেরও একটা চমৎকার সোজা-সাপটা গান থাকে। একটা  গন্ধরাজ,লেবুফুল বিকেল থাকে...  বিকেল, বিকল আংটি-বদলে। শ্রীখোলের সমবেত বাজনা জানিয়ে দেয়,  অবিচ্ছেদ্য জন্ম-ভ্রমণ আগুনের ধ্যানস্থ অক্ষিগোলক...  'ব্যবহারে তুই কেমন দেখি... '   কাকাতুয়া গেয়ে যায় শ্রীহরি -আজান প্রহরে... ' তখন গল্পের তরে..'? কী?শূন্যস্থান পূরণ করতে দিয়ে পানকৌড়ি গালটিপে  'গিলিগিলি গে'!  সিনিয়র -জুনিয়র সমস্ত সরকার,  জায়গিরদার,  সামন্তপ্রভুদল ' আয় হরিনাম নিবি কে রে আয়, আয় আয়... ' গাইতে থাকে অর্ফিয়ুস বাঁশিতে অনবরত  ফুঁ-দিয়ে সুর মেলাতে চাইছে আপ্রাণ...  বুনোঝোঁপ, অসংখ্য লাউডগা সাপ ক্রমাগত ঘিরে ফেলছে অর্ফিয়ুসকে, ছন্দ কেটে হঠাৎ 'ডেসডিমনা' আই-কার্ড নিয়ে, একটা-একটা করে মৃত্যু দাঁতে কেটে অরফিউসকে একটা আস্ত বাতাসের পৃথিবী দিচ্ছে!  অর্ফিয়ুসের শূন্যে 'ফুঁ',কিংবা  সবটুকু বাতাস আসলে ডেসডিমনার ফুসফুসের জন্যই জমা করেছে...  কে-জানে!  ডেসডিমনারা আকৃতিহীন, শর্তহীন  সাদা সুর চেনে কিনা জানি না, তীব্র স্বার্থহীন  -'আকুতি চেনে, আপ্রাণ চেষ্টা চেনে... ' 
' মায়াবৃক্ষের প্রেমের ডালে, শুক-সারি কথা বলে, কথা যে-বুঝেছে সে-ই তো বাউল রে... '

কাঁটাতার পেরিয়ে হলুদ বসন্ত এখন
টিপছাপ আঙুলের উলটো পিঠে,রাধারঙে।একটু পরই সেই সময়। দুই ভ্রূর মাঝে রাজকীয় উপস্থিতি! তখন আমি অনেক দূরে। যেখানে আছি,তারচেয়ে ও! অবিন্যস্ত ছুটন্ত চাকা,টিফিন বক্স, পায়েশ আর পারভিন সুলতানা কেউই আর অকারণ ভরাট করবে না। আসলে শূন্য নেই,স্থানও নেই... অতএব মারফতি গান তলবের ভেতর... সোনা আর গৌর অথবা লক্ষ যোনি ছেঁড়া ফুল সব আটকে গ্যাছে থ্রিডি পেইন্টিং কিংবা মোজার্ট-এর উত্থান-পতনে! অতএব,মদমোয়াজেল তুমি প্রেমিকের চোখে সারিসারি প্রেমিক গুনতে-গুনতে তুমিও ছবির মতো হয়ে যাও। থ্রিডি ডাইমেন্টেড!  তুমিও প্রেমিকের প্রেমিকদের মতো গানের ফেরিওয়ালা হয়ে যাও। দু-চারটে বলিরেখা ঠিক তুমিও গুছিয়ে নিতে পারবেই পারবে! ম্যায়কশি...  বোঝো তো? নইলে বোঝার চেষ্টা করো...  মত্ বাহাঁয়ো আঁসু...  'দিলকি আরমা' অ্যারোমায় চুবিয়ে 'হৃদয়' দ্যাখো ও দ্যাখাও।  সুলেমানকে খুব মনে পড়ে!  হুম। সুলেমানকে। সাড়েতিনহাত মাটির গুঁড়োও!  সুলেমান, তুমি কি জানো আমি এখন মেহেরুন্নিসা... শুনতে পাচ্ছো সুলেমান মেহেরুন্নিসাকে? দেখতে পাচ্ছো!? এখন আমিই তলব করি 'হৃদমাঝার'...  মণিহার এখন মেহেরুন্নিসা
মেন্টর
কেয়ার অফ সুলেমান... তবে, তারচেয়ে আরও আরও অনেক নীচে তার নতুন ঠিকানা...
'পারভিন,পায়েশ আর দুরন্ত-দুদ্দার চাকার কথা' আমার বাড়ির নাম
১১-ই মাঘ অথবা মেঘ
খণ্ডিত আকাশ থেকে আড়াল ভেঙে নেমে আসা দুটি তারা নাকি চোখ, তাকেই কি তুমি লিখেছিলে দুই-কুড়ি আগে ? নাকি ওই তারাদের ভিতরই সবাইকে এড়িয়ে আসলে তুমিও তন্দ্রাহারা রাত্রি লিখে চলেছ চিতাকাঠের দামাল আগুনের মতো? আকাশ ভাঙছে। ভেঙে পড়ছে মেঘ। জলজ-বিশদ। তুমি 'বুড়ির চুল' -এর মতো উড়ছো... কেউ-কেউ তুলো ভাঙার গল্পও বলে। রোজ চাঁদের বুকে বাঁশি রাখি। বিভিন্ন স্কেলের। তোমার তারাদুটিকে তার চোখ মনে হল? গতকাল শুভদৃষ্টি, জোড়া পান আর তোমার সহজ-মুখ দুটো তারার সাথে বেঁধে দিয়েছিল একটা সুতো। নাঃ, ভেবেছিলাম নরম। কিন্তু আসলে উলটো। ফকিরি কি আদৌ পেরোতে পেরেছিল? নাকি সবটাই তহমত অথবা রংহীন পোশাক? আমি স্পষ্ট দেখতে পাই টিকোল নাকের পাখিটা কীভাবে আজও ভাঙা-আকাশ জুড়ছে! দড়ি নেই। পেরেক নেই। মাঝে কোনও পথ ও পোশাক নেই। ঝুলন্ত-তারাদুটিকে তুমি সবাইকে লুকিয়ে খুঁজছো! পাখিটা সুতো দিয়ে উড়ে-উড়ে বাঁধতে চাইছে তারাদের। আদৌ কি তারা নাকি গতকাল শুভদৃষ্টি অতিক্রম করে গভীর চোখ...আমি জানি হেম-সেলাইয়ের মতো আর বাঁকা চোখে তাকে দেখতে হয় না,ইচ্ছে চেপে। আচ্ছা, তোমার বুকে যে-গর্তটা ছিল, তাতে তো আঠারো গজ সাদা-কাপড় ঢুকেছিল। পুঁজ-রক্তে পৃথিবী দূষিত হচ্ছিল যখন ,তুমি তখন বুকের দুধের বাজি রেখে সেই আকাশকে বাইবাই করে কোলে রেখেছিলে সোনালি-চুলের সূর্যমুখী! বুকের সেই খাদেই কি সব-সব লুকিয়ে রাখো? অনেক জায়গা,অনেক অন্ধকার সেখানে... খুব নিরাপদ, না গো? কিন্তু আকাশ দেখতে তো মানা নেই। ইতস্ততরা ভেজা আবিরের মতো ওড়ালেও মাথায় এসে পড়ে... সমস্ত চুল আরও একবার লাল হয়ে ওঠে...সারামাথায় পলাশ-বসন্ত... আজ বাসি-বিয়ে। সিঁদুর সুদূর...
পা রেখে যায় ছাপ... গলি থেকে রাজপথ, নদী-পাহাড়, অরণ্য-সুখা জমি থেকে ভাঙা-আকাশ অক্লান্ত হেঁটে চলা কেবল হেঁটে চলা ...মুঠোর ভেতরে চেয়ে-থাকা আর ছেয়ে-থাকার প্রিয়তম গান...
 মাঘের ভাঙা-আকাশে ঠিক এইটুকুর জন্যই পাখির জুড়ে দেওয়া ঝুলন্ত দুটি তারার জন্ম-জন্মান্তরের থকথকে অপেক্ষা...

অলৌকিক এক মায়া আছড়ে পড়া সন্ধ্যা জানে অন্ধকার আসলে ততটা অন্ধকার নয়, যতটা আলো বলে দিনের ছবি,ততটাও কি আলো থাকে দিনে!  যখন, ফিরে আসার গানে থাকে মনখারাপের জলরং,যখন টপকে টপকে নির্মাণ হয় সিঁড়ির জন্মকথা,যখন তুমি চোখে দেখো সেইসব মুদ্রা যা শুধু চোখের পাড়াতেই ডুবসাঁতারে হয় চিরকালীন, যখন  অবয়ব কেবলই ডুবতে থাকে,ডোবার মুষলধারে নেশায়--- তখন,ঠিক তখন রথের ভেতর রাধারং তিন সত্যি-সত্যি-সত্যি উচ্চারণে হয় বিভোর! একটা জীবন,  অসংখ্য 'সত্যি' সেখানে কখনো রাধা,মীরা, কখনো বসন্তসেনা,বেহুলা, লায়লা কখনো নীলনীল কিছু বিভ্রম! কিন্তু, আসলে সবগুলোই  নির্ভেজাল সত্যি!  প্রতিটি টলটলে জীবনের ভেতর যেমন চমৎকার কিছু মৃত্যু লেগে থাকে, ঠিক সেভাবেইই প্রতিটি মৃত্যুর গায়ে লেপ্টে থাকে প্রিয়তম জীবন! এভাবেইই কখনো জীবন কখনো মৃত্যু নিয়ে ছেনতে গিয়ে হেসেছি যতবার,কেঁদেছি তারও অনেকগুণ বেশি!  কিন্তু এর ভেতরই শুনেছি সেই আশ্চর্যকথা... এর ভেতরই দেখেছি তোমার টুকরোগুলো জুড়ে-জুড়ে গড়ে তোলা সেই ভাস্কর্যকে,যাকে দেবী বলো আনমনে,এর ভেতরই শুনেছি সেই মনজুড়োনো ডাক
'না-বলা'.... এর ভেতরই ছুঁয়েছি পাঁজড়ের দাঁড়!  মননগর থেকে যে -গন্ধ তুমি মিশিয়েছো সমগ্রজুড়ে, সেই গন্ধ লুঠ হতে দেখেছি ১৩ বছরের চাঁদ আর আমি। আমি চোখবুজে ছুটছিলাম।  কেবল ছুটছিলাম। অতল জলের ডাক।  তীব্র এক গতিময়তায় এখনো,  দু'পায়ের পাতায় অসংখ্য ফোস্কা... ঘুমের ভেতর-ঘুমের বাইরে -আলোর ভেতর-আলোর বাইরে শুধুই সেই চোখ-মুখ-বুক! যতটা কাছে এসেছি,তার চেয়ে ঢের দূরে আছি, যেমন ছিলাম! আকাশ ধরতে  ধরতে ভুলে গেছি নিজের মুখ! কী আশ্চর্য!  চিনতে পারি না আমাকেই! অহর্ণিশ তবু আকাশ পড়ার তুমুল নেশা! ধারণের ধারণায় যে-মেঘ কে ছেড়েচি ওর আঁচলে চিরকালের জন্য, সেই মেঘ কেন জানবে কার বুকে কী আছে আর কেন আছে!  আসলে জলের গান আর কান্নার পার্থক্য বোঝাটা খুব জরুরি,  গুলিয়ে ফেললেইই যাবতীয়  ঘুম-ঘুম! তখুনি আগুন, দহন, দাবানলের ভ্রমর! শুধু গুঞ্জন আর গুঞ্জন!  কিন্তু ' নেই ফুল আমার শূন্য কানন '! কিন্তু অজস্র নক্ষত্রবাগানে সারেঙ্গী যখন গিলছে তোমার আঙুলের সংসার,গিটার ফেলে,তখন আমি কালির দোয়াতে ডোবাই খাগড়া... তিনপুরুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাবাই ঘাসের নরমে, প্রতিরাত লিখে চলে মহাকাব্যের পরবর্তী অধ্যায়!
'এ-বাঁচা আমার কাছে ঘোর পরবাস... আমাকে সঙ্গে নাও দখিনা বাতাস'...  সবটুকু দেওয়ার পরও... সবটুকু পাওয়ার পরও...

মা
কে
না   

আগুনের শ্লোক - নদীর গান- বৈদিকমন্ত্র - অথবা ধুমধাড়াক্কা শ্রাবণ কিন্তু আমাকে কেউ নাও...

পানকৌড়ি, বেলে মাটির গাছটা মনে পড়ে?মনে পড়ে ঈশ্বরকে খুনোখুনির কবিতা,সরগম?
জানালার কাচ পেরোচ্ছে একটার পর একটা নদী। সব নদীকে জানা হয়নি এখনও।অথবা জানাই,কিন্তু জানাই হয় না যে জেনেছি। ঠিক জল বরাবর ছায়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উড়ছে ইরানি-বালিকার স্বপ্নের মতো। বছর কুড়ি আগের বা পরের লাবণ্য অথবা বিভ্রম। জড়িয়ে রেখেছে পা...
মুখস্ত গল্পের মতো ঝরঝর করে এগিয়ে যাচ্ছে তারিখ।দৃশ্য লিখে-লিখে চলে বুনোপাখি।
আনমনে পাণ্ডুলিপি নিজেই সেজে ওঠে। প্রচ্ছদের সাথে গভীর আদর আর তুমুল যৌনতা, অবিকল মগ্ন এমএ পাঠরতা ইতিহাসের মুখচোরা ঝুঁকিহীন ছাত্রীটি যেন।

দীর্ঘ রাস্তা যখন রাজপথ হয়, তখন ফুটপাথে মুছে যায় সবক'টা  সাদা ফুলের ঘ্রাণ। রূপহীন-আকারহীন বনলতা আরও সামনে এগোতে-এগোতে আনমনে ঢুকে পড়ে অখ্যাত কোনো ঘন-ঘন বাঁক-বদল হওয়া গলির ভেতর...সেখানে পাখির ডাক জেগে থাকে সন্ধ্যামালতীর পাতা অথবা মাধবীলতার বুকে। ঘর ছাড়া রাজদ্রোহী অথবা আন্ডার ট্রায়াল ক্রিমিনালের জীবনের মতো নেমে আসা রাত্রিও এখানে মুদ্রা বদলের সাহস দেখায় পায়ের কারুকলায়। পাকদন্ডী পথের মতো কেবল জড়াতে থাকে বনলতার আঁচল। চারদিকে শুধু শান্তির শব্দ। বাঁ-দিক, ডানদিক,মাঝবরাবর ইরা-পিঙ্গলা-সুষুম্নার এক আশ্চর্য ব্যালে!দেবীঘাটে আশ্চর্য  সুর গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী বেণী খুলতে-খুলতে চোখ রাখে মিহি ধুলো আর আরও-একটা ডিপার্চারের দিকে...
জানি,আবারও দেখা হলে বলবেই...
'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
বনলতার জন্য পানকৌড়ি দু'ঠোঁটে আজও আঁকড়ে রেখেছে হাওয়া আর রঙিন মাছ,যার চোখে শত-শত বর্ষ আগে কেউ পরিয়ে দিয়েছিল মায়াকাজল...

4 comments:

  1. এমন মায়াবী সম্মোহন...ছুটে যাই সেই সঙ্গমস্থলে । আপনি যদি ছবি আঁকতেন....

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. অসামান্য মায়ামেদুর গদ্য। ভালো লাগলো মনোনীতা।

    ReplyDelete

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম