Thursday, May 30, 2019

গৌরাঙ্গ শ্রীবাল-এর কবিতা



লাশঘরে লেখা কবিতাগুচ্ছ
কবিতার টান

অন্ধকারের মতো এখানে আলো
অথবা আলো ও অন্ধকার যেন গর্ভের গভীর থেকে উঠে আসা কথা,
এমন কথারঘরে অনেকলাশের পাশে বসে একটি লোক
বাঁশিতে ফুঁ দেয়, যার চোখে মাতালের রাগ
ঠিক বুনো মহিষের চেয়ে থাকা, বাঁশির সুরেলা ধ্বনি শুনতে শুনতে
থেমে গেছে জীবনের গতি, তবু মনে হয় জাদুর ছোঁয়ায়
স্থির হাতে-পায়ে লেগে আছে কোনো অস্থির নাচের ভঙ্গি।
সে লোকটি গান গায়, মর্গের খাতায় লেখা লাশের হিসাব হয়ে ওঠে
কবিতার শরীর, যে শরীরের মুখ পরানের দিকে
অথচ এ ঘরে লোকগুলো মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে ঠিক উলটো রথ
ফিরে যাচ্ছে যে যার নিজের পথে, এ পথে কবিতাগুলো
তার মৃত সৈনিকের, হৃদয়ের রক্তে লেখা উচ্চ ইস্তাহার

জোরালো ইস্তাহারের ধ্বনি শুনে
হিমের শীতল দেহ তাদের অন্তর আত্মা কখনো কখনো
আকাশ বাতির দিকে স্বর্গের অনেক কাছে যেতে গিয়ে ফিরে আসে
তার কবিতার টানে, মাটিতেই শুয়ে থাকে
ছেনি হতুড়ির ঘায়ে মাথা ফাটানোর কিংবা ধারালো ছুরিতে বুক চেরার সময়
নিজেরাই স্বাগত জানায় মদে চুর হয়ে থাকা লাল আঁখির সে লোকটিকে
প্রিতি-উপহাররূপে তার হাতে তুলে দেয় চোল চোল নষ্ট রক্ত
বুকের ভিতরে ভালোবাসার চিহ্নের মতো নিরেট হৃৎপিণ্ড।

লাশঘর

ঘর থেকে পা বাড়ালে মৃত মানুষের গায় পা পড়ে, আবার
বাইরে থেকে ঘরে এসে যখন উঠোনে আমি দাঁড়াই তখনো
পায়ের তলায় দেখি যেন কার দেহ পড়ে আছে।
আত্মার আত্মীয় সব নয়, শত্রুমিত্র মিলে মৃত
মানুষের জড়ো হয়ে উঠেছে শবের স্তূপ
এসির বাতাসে গন্ধ ছড়াচ্ছে অনেক দূর,
সারা পৃথিবীটা আজ শবের আগার।
শবাগার বললে লোকে যতটা না বোঝে
তার থেকে আরো বেশি ভালো করে বোঝে লাশঘর যদি বলি।

প্রতিটি মৃত্যুই একটি পূর্ব-পরিকল্পিত অদ্ভুত দুর্ঘটনা
ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক প্রেমের
অতৃপ্ত বাসনা থেকে এই মৃত্যু,
সকলে মৃত্যুর পর জড়ো হয় এক পরিবারে
তখন তাদের একটাই ঘর আর একটাই পরিচয়
শুধু শব আর লাশ মৃত্যুর পরিপূর্ণ বিকাশ,
মানুষের দেওয়া নাম ভূতের মতোই ঘুরে বেড়ায় বাতাসে,

চারদিকে ছড়ানো লাশের মাঝে আমি তাদের বিবর্ণ
অসম্পূর্ণ হিসাবের খাতাটা টেনে নিয়ে কী লেখা আছে দেখি,
ভুলে যাই আমার এ জীবনের কথকতা লিখে চলি অনেক কবিতা
বেঁচে থাকা মানুষের জন্য নয় অজস্র লাশের জন্য আমার কবিতা লেখা,
পাঁচালি শ্রোতার মতো আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে যারা

মৃত্যুর পরে ভোর

বেঁচে থেকে এতদিন তুমি পাওনি যে স্বাদ সে স্বাদ আজ
পেয়েছ মৃত্যুর পর, শুয়ে আছ লাশঘরে
সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এক অপরিচিত পুরুষ
মানুষের বুকের উপর তারও গায়ে কোনো
পোশাকের ছিটেফোঁটা নেই,
যেন কী মধুর সঙ্গমের তৃপ্তিতে তুমি ও ওই
অচেনা পুরুষ তৃপ্ত, যে তৃপ্তির নীরব আবহে
কোনো কথা নেই তোমাদের মুখে, তবু যেন অজস্র কথার প্যাঁচে
দুজনে নিথর বাহু জড়িয়ে ঘুমের দেশে চলে গেছ।

মৃত্যুর পরেও ওই তোমার নিতম্ব কিংবা
স্তনের স্নিগ্ধতা আর নাভির গভীর অন্ধকার আজো
নিশিডাকের মতন ডাকে,
এ ডাক উপেক্ষা করতে পারি না আমি, তোমাকে নিয়ে যেতে
এসেছি রাতের শেষে: ব্রাহ্মমুহূর্তের কাল

তোমাকে হৃদয়ে করে নিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়েছি এই
নীরব নদীর ধারে, করোটি রঙের জলে স্নান করে চাঁদ ওঠে
তরল ফ্যানের রঙে এ জ্যোৎস্নায় এলো চুলে শুয়ে থাকা
কিশোরী তারার বুকে কবিতার প্রতিটি পাতায় জেগে ওঠে
তোমাকে ভাসিয়ে দিই,মৃত্যুর পরেও আসে
অস্থিভস্মের মতো বাতাসে ভেসে বেড়ানো নরম ভোর।

অনেক দূরের কথা

আমি এক বিশুদ্ধ মাতাল বসে আছি লাশঘরের চাতালে
মৃত সব যুবতীর গভীর নাভিতে ঢেলে জিভ দিয়ে চেটে খাচ্ছি মদ
কিশরীর পচা ঘিলু করোটির খুলিতে রেখেছি তার নরম স্তনের চাট।
এই স্বাদ কোনোদিন পেতাম না আমি
যদি এই সময়ের হাত ধরে দীর্ঘ সারিবদ্ধ
অথবা হতাশ হয়ে বেড়ানো বেকার
যুবক ও যুবতীর মতো ঘুরে বেড়াতাম তাহলে যেকোনো দিন
ফুটে বাতাসা হয়ে যেতাম কিংবা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত
যেভাবে নতুন ব্রিজ ভেঙে পড়ে
পুরোনো তো অনেক দূরের কথা।

এ কথার কী উত্তর দেব বল
আমাকেও দিতে হত খাদ্যের পরীক্ষা,
ওরা থাকে ও ঘরে এ ঘরে থাকি আমি
কেমন অভ্যস্থ হয়ে গেছে ওরা আমার এ জীবনের সঙ্গে, ভাবি
মৃত্যুর স্বাদের থেকে এ স্বাদ অনেক ভালো
যে স্বাদ কখনো জীবনের কাছে উপদ্রব হয়ে আসে না এবং
ব্যথার যন্ত্রণা দেখে পাশে দাঁড়ায় না কিন্তু
কাছে এসে মোবাইলে তুলে রাখে রঙিন ভিডিও ছবি,
এখানে এসব ঝুট-ঝামেলার চেঁচামেচি নেই।

ডোম

মধুমিতা শোন, দেখ আর কোনো চিন্তা নেই
আমি এমে পাশ করে চাকরি একটা পেয়ে গেছি খুব বরাতের জোরে
লাশের হিসাব রাখি প্রতিদিন ডোমের খাতায়
পরে থাকি মেথরের জুতা জামা প্যান্ট,
কাজের অন্তরালে তোমাকে ভাবি আর এক নিবিষ্ট হয়ে বাঁশি বাজাই
নিথর শবের মাথা বুক থেকে পেট নাভি পর্যন্ত ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে
ফালা ফালা করা হয় যেভাবে সেভাবে চিরে দিয়ে যায়
সে বাঁশি রাতের ঘন গভীর নিস্তব্ধতাকে।

এখানে কি পাবে তুমি জীবনের গন্ধ,পাবে কি জন্মের স্বাদ!
ডোমের মেয়ে তুমি, তোমাকে ভালোবাসা বুঝি আমার এ মাহিষ্য বর্ণের অপরাধ
তাই আমি নিজে থেকে মেথরের পরীক্ষায় হয়েছি মাতাল ডোম।
মায়ের আনন্দ দেখি আমার বাবার গর্বে
গোপনে জেনেছি আমি আমার নিকট আত্মীয়েরা
তোমাকে খুনের প্ল্যান করে তারা দাদা কাকা মামা কিংবা
বাবাও হতে পারে যাদের যৌন তাড়নায়
তোমার মৃত্যুর আগে যোনির সতীত্ব পর্দা ছিঁড়ে যেতে পারে।

এটাই তো স্বাভাবিক বেঁচে থেকে
যে জীবনে কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারিনি আমি নিজেও দেখিনি কোনোদিন,
তোমাকে মৃত্যুর পর এখানে আমার আরো অনেক নিজের করে পাব আর
দেখাব দেখাব কত নতুন নতুন নিত্য স্বপ্নের ঠিকানা।
সমস্ত দেহের অলিগলি ঘেঁটে মাঝেমধ্যে এক
দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে আর কিছুদিন পর আমি
পেয়ে যাব লাশকাটা বিদ্যায় পি-এইচ-ডি
জোনাকি বাতির ঢঙে তোমার দেহের আভা পেয়ে জ্বলবে নিভবে
ঘাসের গুচ্ছের মতো আমার চুলের অন্ধকারে;
এরকম জোনাকির জ্বলা-নেভা দেখে দাদু বুঝে যেত
আর ক-দিন পরে এখানে ঘনীভূত হবে নিম্নচাপ নামবে বৃষ্টি
 vv

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

ভেঙে যাওয়ার পরে- একটি উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়া- রিমি মুৎসুদ্দি

  ‘মৃত্যুতে শোক থাকে কিন্তু সামাজিক অপযশ থাকে না । ’ ‘ মৃত্যু ’ ‘ শোক ’ ‘ অপযশ ’- একটা গোটা উপন্যাস থেকে এই তিনটে শব্দই কেন...

পছন্দের ক্রম