পায়ের তলায় সর্ষে...
বাবা মায়ের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আমার
আর ভাইয়ের পায়ের তলাতেও তাদের পাকাপাকি ঠাঁই l
" আমাদের ছুটি ইঙ্গিতে বোঝাবুঝি
"
গরমের ছুটি মানে মে মাস,আমরাও লোটাকম্বল
বেঁধে ট্রেনে চাপতামl হাওড়া থেকে দূর পাল্লার ট্রেন lকোথায় যাওয়া হবে এটা বাবা মা আমি
আর ভাই বেশ একটা গোল টেবিল বৈঠক করে ঠিক করে নিতাম l মাস চার পাঁচেক আগেই, কারণ ট্রেনের
টিকিট কাটার ব্যাপার ছিলো l
ধরে নেওয়া যাক গন্তব্য "কেদারনাথ"
ভ্রমণ আর আরও বেশ কটা ম্যাগাজিন বাবা নিয়ে আসতো, অতি অবশ্যই বার্ষিক
পরীক্ষার পরেl রোজ রাত্তিরে খাওয়ার পর আমি ভাই বাবাকে ঘিরে বসতাম,বাবা পড়ে শোনাতো,কোথায়
যাচ্ছি, সেখানকার ভৌগলিক বৈশিষ্ট, ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক গুরুত্ব এই সব, মা তাড়া দিতো, "কাল বোলো, ওরা এবার ঘুমোতে যাক, রাত হয়েছে
তো" l বাবাও হেসে হেসে বলতো "বেশ বাকিটা কাল রাত্তিরে "l
বেড়াতে যাওয়ার আগের বেশ কিছুদিন চলতো এই গৌর চন্দ্রিকা পর্ব l এবার যেদিন বেরোবো সেই দিনের
চিত্র,
রাত্তিরে ট্রেনে খাওয়ার মেনু টা কিন্তু
ভীষণ ইম্পরট্যান্ট, চিকেন কষা, রুটি বা পরোটা, আলুরদম, কিমা দিয়ে ঘুগনি, ফ্রাযেড রাইস, গোল গোল আলুভাজা, আর মিষ্টি !!!!নকুড়, ঘোষ,
হরিদাস মোদক, অমৃত, সেন মহাশয় ,সন্তোষ এমনকি কে সি দাশের রসগোল্লার কৌটো অব্দি, কিছুই বাদ যেতোনা আর কীl
আমরা ছোটরা সঙ্গে আছি এই অজুহাতে শুকনো
খাবারও সঙ্গে থাকতো বৈকি, বড় জ্যেঠু চানাচুর,বাদাম আর বিস্কুট,
মৌ (মেজোমা ) দিতো চিড়ে ভাজা,গাঠিয়া,মিষ্টি,
সেজদি হয়তো ঝুড়িভাজা,সন্দেশ,চকলেট,
দিদুন, মাসি হরেকরকম নিমকি, ক্ষীরের কালাকাঁদ,অর্থাৎ বারোদিনের ট্যুরে প্রায়
ছত্রিশ রকম টুকি টাকি খাবার l একটা ব্যাগ নেওয়া হতো খালি ওইসব নেবার জন্য l ট্যাক্সিতে
তুলে দেবে বলে গোটা পরিবার পাড়ার মোড়ে একত্রিত সেদিন, আমরাও নারায়ণ মন্দিরে প্রণাম
করে বড়োদের প্রণাম করে ট্যাক্সি চাপতাম, ওলা,উবার নয়, হলদে ট্যাক্সি l প্রায় আধঘন্টা
ধরে চলতো এই যাত্রাশুরু পর্ব,মানে রাত্তির আটটার ট্রেন তো বাড়ি থেকে বেরোতাম পাঁচটায়,
বড়বাজারের যানজটের জন্যও তো বেশ কিছুটা সময় ধরে রাখতে হতো নাকী?ব্যাগপত্তরও কম হতো
না কিছুই, তখনও ট্রলি এসে স্যুটকেস কে গায়েব করে দেয়নি পুরোপুরি,দুটোরই বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান,সাথে আরও খানকতক ব্যাগ,তারমধ্যে একটা
ওষুধপত্রের আর মিল্টন এর ওয়াটার কুলারl
যেইনা
বাঁক পেড়িয়ে ট্যাক্সি হাওড়া ব্রীজ ধরতো,উফফফ সে কী আনন্দ, পেটের ভেতরটা গুবগুব করতো আনন্দের চোটে l দূরে দেখা যাচ্ছে নিয়ন
আলোয় লেখা হাওড়া স্টেশন l
আমার পিসেমশাইকে দেখতাম যখনই হাওড়া ব্রীজ পেরোতেন এক টাকার কয়েন গঙ্গার
উদ্দেশ্যে দিতেন, সেটা এখন কেমন এক অভ্যেস
হয়ে গেছেl
আজও সে অভ্যেস বহাল তবিয়তে বিদ্যমান l
কোন
প্লাটফর্মে গাড়ি,কোচ নম্বর আর সিট্ নম্বর কত সব দেখে শুনে, ব্যাগ পত্তর ঠিক
মতো রেখে চেইন দিয়ে বেঁধে তবে নিশ্চিন্তি হয়ে বসা,বেশ কয়েকবার কিন্তু স্লীপার ক্লাসেও
গিয়েছি,তখন যাওয়ার আনন্দে যাত্রাপথের কষ্টটুকু ম্লান হয়ে যেত,রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার
পর্ব মিটলে কে কোন বাংকে ঘুমোবে সেটা ঠিক করা হতো,সাধারণত একদম উপরের টা আমার পছন্দের,এইবার আমার মাতৃদেবী
একটা ব্যাগ আমার পায়ের কাছে রাখতেন,তারপর আরও একটা চেইন দিয়ে আমার পা, ব্যাগ, বাংক
এর আংটা সব একসাথে বেঁধে দিতেন, আরে এসব সেফটি মেসার,তার কন্যারত্নটি যাতে এপাং ওপাং
ঝপাং না হয় তাই, এইভদ্রমহিলার দূরদৃষ্টি নিয়ে আমার কোনোকালেই কোনো সন্দেহ ছিলোনা আজও
নেই.
এইপ্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি,সেবার আমরা
লখনৌ চলেছি,অমৃতসর মেল প্রায় বারো ঘন্টা লেট,মোঘলসরাই স্টেশনে ইঞ্জিন চেঞ্জ হতো,মা কুলারে জল ভরতে প্লাটফর্মে নেমেছে,হঠাৎ দেখি ট্রেন টা দুলকি চালে চলতে লেগেছে,আমি তো ওমাগো বলে উপরের
বাংক থেকে ঝপাং করে লাফ দিলাম, হাত পা কেটে গিয়ে একাকার কান্ড, উপরি পাওনা হাতে পায়ে
ওষুধ ঘষতে ঘষতে বাবা মায়ের বাক্যবাণ "এতবার বেড়াতে যাচ্ছিস জানিসনা,ইঞ্জিন চেঞ্জ
করে একটু টেস্ট করে নেয় "...হে পাঠক বিশ্বাস করুন ওইসময়ে একমাত্র কিছু সহযাত্রীকেই
ভীষণ আপনজন মনে হয়েছিলো,তারাই একমাত্র বুঝেছিলেন আমার মাতৃভক্তি অপার
ট্রেন যাত্রায় আমার একটা বিষয় নিয়েই ভীতি
ছিলো,সেটা হল একমাত্র রাত্তিরটুকু ছাড়া পুরো সময় যে স্টেশনেই ট্রেন থামতো বাবা নামতো,অনেক
সময় খাবার জল আনতেও, আর আমি দু মিনিট পর থেকেই
জানলা দিয়ে হা হা করে চিৎকার করতে থাকতাম "ও বাবা উঠে এসো, উঠে এসো
" গাড়ি যেই একটু নড়ে উঠতো, কান্না শুরু, এই ভেবে যে বাবা স্টেশনেই রয়ে গেছে, অবশেষে
চোখের সামনে দেখে তবে কান্না থামতোl
একবার ট্রেনে উল্টোদিকের সহযাত্রী ছিলেন
এক শিখ পরিবার,তো সেই ভদ্রলোক আমার ক্রাইসিস টা যথার্থ ভাবেই বুঝেছিলেন মাত্র দুবারেই,বাবাকে
বললেন যে আমাদের জল তিনিই এনে দেবেন আর বাবা
এমনি যেন না নামে,অমন সহৃদয় সহযাত্রী আমি এজীবনে
আর দুটি দেখিনিকো..
আমরা অধিকাংশ সময়ে অনেকে মিলে বেড়াতে যেতাম,আমাদের
পারিবারিক কিছু বন্ধু ও তাদের পরিবার আবার ট্রাভেল এজেন্সীর সাথেও যেতাম...কতশত পথের
আলাপ পারিবারিক বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে..
কথায় বলে যাত্রাপথের আনন্দগান, দুটো ঘটনার
কথা বলি,
প্রথমটা 2005 এ, কাশ্মীর থেকে ফিরছি, দিল্লী থেকে দুন এক্সপ্রেসে
উঠলাম,বেশ সক্কাল সক্কাল,সেবার আমাদের সঙ্গী আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ও তার পরিবার,
ট্রেন এ সকলে উঠে বসেছি, এবার ব্রেকফাস্ট করতে হবে,হঠাৎ করেই বাবার মনে পড়লো রসগোল্লার
টিনের কথা, উঠলো বাই তো রসগোল্লা খাই, যেমন ভাবা তেমন কাজ, আমার অতি তৎপর পিতৃদেব টিনের
ঢাকনা খুলতে উদ্যত হলেন, মা যত বলছে "আস্তে করো,ছিটকে না যায় " তা বাবাকে
থামায় কার সাধ্য,"দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান " এই মন্ত্র জপে বাবা
টিনের কৌটোর ঢাকনা ধরে দিলো এক টান ব্যাস সমস্ত
রস চলকে বাবাই দাদা মানে ডাক্তারজ্যেঠুর ছেলের জামা প্যান্ট ভিজে জবজবে,আমরা হেসে কুটিপাটি, যাইহোক বাবাইদাদা সব জামাকাপড় চেঞ্জ করে হাফ প্যান্ট
আর টি শার্ট পরে এলো,সবাই তখন চা খেতে ব্যস্ত আর চা ওয়ালা অতি দ্রুততায় কেটলি থেকে চা কাপে ঢালতে গিয়ে ঢেলে
দিলো বাবাইদাদার গায়ে l বাবাইদাদার প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা ধপাধপ পা ফেলে আবারও গেলো
স্নান ও চেঞ্জ করতে, আসবার পর সেই যে ওপরের বাংকে উঠলো বাবাই দাদা হাওড়া আসবার আগে
আর মাটিতে পা দেয়নি,
এবার দ্বিতীয় ঘটনা, 2015 সাল, জানুয়ারীর
2তারিখ, সকালে কন্যাকুমারী স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম আমরা,কেরালা ঘুরে ফিরছি, আমাদের
সঙ্গে যারা গিয়েছিলেন তারা হাওড়া নামবেন, আমরা যাবো চেন্নাই এগমোর, সেখানে বাবার বন্ধু
রাজামনি আঙ্কেলের বাড়িতে একদিন ঘুরে আমরা আকাশপথে পৌঁছবো কোলকাতায়l তা ট্রেন বেশ লেট,
ট্যুর ও শেষপ্রায় তাই মনকেমন আর অবসাদ মিলেমিশে উদাস হতে হতে আমি আর ভাই এক রকম ঘুমিয়েই
গেছিলামI আমাদের একটা সাইড আপার আর লোয়ার আর দুটো মিডল সিট বরাদ্দ I এবারে বাঁ দিকের লোয়ারে এক ভদ্রলোক দিব্যি
কম্বল মুরি দিয়ে গভীর ঘুমেl আমাদেরও বেশ শীত লাগছে, বাবা তাই আমাদের গায়ে চাদর দেবে বলে উপরের সিট থেকে চাদর নামাতে গিয়েছে,বিপত্তি
ঘটলো এইবারে, চাদরের বদলে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পরতে লাগলো ফ্রুট কেক,ঝুড়িভাজা, সন্দেশ,
কুকিস,আমার মনে পরে যেতে লাগলো "আয় আয় আয়রে আয়, মন্ডা মিঠাই হাঁড়ি হাঁড়ি.......
"l ভদ্রলোকের অবস্থা পুরো
ছাতের ওপর কাক আমিতো অবাক, খানিক নোনতা
মিষ্টি স্বাদ জীভ দিয়ে চেটেও নিলেনl আমি আর ভাই ঘুম ভেঙে উঠে দেখি পুরো দক্ষ যজ্ঞ বেঁধে
গেছে, আমরা হাজার চেষ্টা করেও থামাতে পারলাম না নিজেদের, হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরছি প্রায়, আর বাবা ওনাকে বারবার
সরি বলছে,উনিও বুঝলেন ঘটনাটা একেবারেই আকস্মিকভাবে ঘটেছে, কিন্তু গল্পের শেষ এখানেই
নয়, কে বা কারা ওই খাবারগুলো ওখানে রেখেছে এটা জানবার জন্য বাবা প্রায় তদন্ত কমিশন বসিয়ে দেবে যখন,ট্রেন এসে ভিড়লো
এগমোর স্টেশনে l কিন্তু আমার পিতৃদেব মোটেও দমে
যাবার পাত্র নন,স্বয়ং ফেলুদা তার মাথায় ভর করেছেন,হোটেলে পৌঁছেই আমাকে আর ভাইকে
জোরকদমে জেরা করতে শুরু করলো,খাবার গুলো কে রেখেছে সেই নিয়ে, আমরাও বেগতিক দেখে সিদ্ধান্ত
নিলাম "ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে
লও সহজে ",বলেদিলাম যে আমরাই রেখেছি আর ভুলেও গিয়েছি তা বেমালুম,বকুনি খেলাম প্রচন্ড
অবশেষে গেলাম ঘুমোতেl
প্রতিটা গরমের ছুটি রঙিন হয়ে আছে এসব জলছবির
রঙে, সব রং আর বিত্তান্ত এক ক্যানভাসে ধরানো মুশকিল হি নেহি না মুমকিন হ্যায়l তাই এইখানেই আপাতত ইতি টানলুমl বাকি রং
তোলা থাকলো অন্য কোনো ক্যানভাসের অপেক্ষায় l
No comments:
Post a Comment