অনেকগুলো বছ র আগে আমি
আর সৌরভ সিমলা বেড়াতে গিয়েছিলাম।তখন এ.সিতে যাবার কথা ভাবতেও পারতাম না।দিল্লি পর্যন্ত
স্লিপারে রিজার্ভেশন পেয়েই বেজায় খুশি আমরা।দিল্লি থেকে কালকা গিয়েছিলাম জেনারেল
বগিতে।চণ্ডীগড় আসতে ট্রেন বেশ ফাঁকা হয়ে গেলো।ব্যস,লম্বা হয়ে হাত
-পা মেলে শুয়ে পড়লাম
দু-জন দুটো জায়গা দখল করে।শুয়েই অন্যজন ঘুমে কাদা।আমার আবার ট্রেনে ঘুম হয় না;তবু
কী করে যেন কালকা পৌঁছনোর মুখে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।কালকায় ট্রেন দাঁড়িয়ে
পড়েছে-আমাকে ডেকে তুলে সৌরভ এগিয়ে গেলো সিমলার টয়ট্রেনের টিকিট কাটতে।সে আবার
লম্বা একটা লাইন।যা হোক,টিকিট পাওয়া গেলো।তখন একটু আলো ফুটেছে মাত্র।দু-জনে দুটো
চায়ের ভাঁড় হাতে ছোট ট্রেনের লাইনের পাশে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছি;সৌরভ আমাকে
ধরে পিছন ফিরিয়ে দিয়ে আঙুল দিয়ে দূরে একটা পাহাড় দেখিয়ে বলল-'ঐ দ্যাখ সিমলা,আমরা
ঐখানেই যাবো।'সেই প্রথমবার সিমলা পাহাড় কে
চোখে দেখার অভিজ্ঞতা,
অনুভূতি লিখে বোঝানো সম্ভব নয় বোধহয়।একটা কাজলধোয়া জলের রঙের আকাশ,তাতে কালচে নীল
একটা পাহাড়-পাহাড়ের মাথায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছে কয়েকটা সোনালি আলো।যেন সোনার মুকুট
পরে দাঁড়িয়ে সে,সুন্দরী সিমলা পাহাড়।এ দৃশ্য ভোলার নয়।তারপর কতবার গেলাম সিমলা,
হিমাচলপ্রদেশ- এমনটি আর দেখতে পেলাম না। গুনে দেখেছি অন্তত চোদ্দবার সিমলা হিমাচল
গেছি আমরা।কখনও আমরা দু'জনেই,কখনও বন্ধু-বান্ধব,বন্ধুর পরিবার মিলে।
একবার গেলাম রকছাম।রূপিন নদীর গা ঘেঁষে ছোট্ট একটা গ্রাম।সেবার
ছিলাম চারজন।আমরা দু-জন আর বুবলা দা আর সংঘমিত্রাদি।এই রকছামে আমাদের কোন হোটেল
ইত্যাদি বুক করা ছিলো না।যাকে বলে হারা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া আর কী!আসলে থাকব
ভেবেছিলাম সাংলায়।কিন্তু থাকতে গিয়ে দেখি হোটেলের দাম খুবই চড়া।ফলে 'আরেকটু এগিয়ে
দেখি,আরেকটু এগিয়ে দেখি,আরএকটু...'এই করতে করতে এই রকছামে এসে পড়া।জায়গাটা ভারী
পছন্দ হয়ে গেলো আমাদের।ম্যাপে দেখেছিলাম,এর পরই খানিক দূরে ভারতের শেষ গ্রাম ছিটকুল।সাংলা থেকে
সেখানে দেখতে যাবো- ভারত-তিব্বত সীমান্ত-এমনটাই প্ল্যান ছিলো।যা হোক,রকছামে ইতি
উতি জিগ্যেস করে আর আমাদের গাড়ির ড্রাইভার 'কাকুজী'র সহায়তায় একটা আস্তানার খোঁজ
মিলল।তখন বিকেল ঢলতে লেগেছে সন্ধের দিকে।আমরা গাড়িতেই বাক্স-প্যাঁটরা রেখে চললাম
রাস্তার পাশে নদীর দিকের একটা বাড়িতে।জানা গেলো-ওটি রকছাম পোস্ট অফিস।রাস্তার
সমান্তরাল ঘরগুলোর চারটের একটায় পোস্ট অফিসের কাজকর্ম হয় আর ওপর তলার চারটে
ঘর।গোটা সাতেক ঘর কুল্যে ভাড়া দেওয়ার জন্য।প্রবল হাওয়া তখন বাইরে।আমরা চটপট দু-টো
ঘর পছন্দ করে ফেললাম-যেগুলোর জানলা দিয়ে নিচে বয়ে চলা রূপিন নদী খুব ভালো করে দেখা
যাচ্ছিল।এই পোস্ট অফিস আর অতিথিদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন সূরয সিং।তিনি একাধারে
কেয়ার টেকার আবার রাঁধুনিও।ওঁরই তত্ত্বাবধানে আমরা স্নানের গরম জল থেকে
চা-কিছুমিছু খাবার-সবই পেলাম।প্রসঙ্গত,ঐ ঠাণ্ডায় পাহাড়ি সন্ধের সময় আমাদের স্নান
করার ব্যাপারটা এড়াতে পারলেই ভালো হ'ত-এড়ানো গেলো না।কারণ আসার পথে অনেকটা পথ শুধু
ধুলো আর মাটি পেয়েছিলাম।চড়াই আর ভাঙা রাস্তার দরুণ গাড়ি ঠেলতেও হয়েছে।ফলে গা মাথা
এমনকি চোখের পাতাতেও ধুলোই ধুলো।তো,আমরা স্নান টান সেরে চা খেয়ে আড্ডা দিতে বসার আগে ঠিক
করলাম পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবো।এমনিতেই ঘর গুলো পাথুরে দেওয়ালের বলে-বড্ড
ঠাণ্ডা।ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি বাইরে থেকে উঠে গেছে।কাঠের সোজা সিঁড়ি।গেলাম
ওপরে।রাস্তার গায়ে করিডোর আর ডান হাতে তিনটে ঘর।সোজাসুজি গেলে একটা পাঁচ বিছানার
লাগোয়া বাথরুম ওয়ালা একটা ঘর।এ ঘরের সবটাই কাঠের আর একটা দেওয়াল পুরোটাই কাচের
জানলা।আর আমাদের পায় কে!সূরয সিংয়ের সাথে কথা বলে রাজি করিয়ে ঐ বিরাট ঘরটার
দখল পাওয়ার অপেক্ষা।ইতিমধ্যে আমরা আবিস্কার করে ফেলেছি দুটো ব্যাপার।পিছনদিকে পাথরের ধাপ কাটা
আছে নিচে নামার জন্য-ওখানে রান্নাঘর আর একফালি জমি।আর ওখান থেকে পায়ে চলা পথ ধরে
একটু গেলেই রূপিন নদী।সে নদীর ওপর ছোট্ট একটা কাঠের সাঁকো।সে রাত ছিলো
পূর্ণিমার।আমরা ঐ প্রবল ঠাণ্ডাকে পাত্তা না দিয়ে সাঁকোর ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশ
দেখছিলাম প্রাণ ভরে।নদীর চকচকে গলানো রূপোর মত জল আর দূরে পাহাড়ে জ্যোৎস্না ধোওয়া
বরফ।আমাদের যেন বশ করে ফেলছিলো।আচমকা বুবলাদার চ্যাঁচানিতে হুঁশ ফিরলো
আমাদের।আমাকেই উদ্দেশ্য ক'রে ও চেঁচিয়েছিলো।আসলে হয়েছিলো কী,ঐ সাঁকোটার কাছে
পৌঁছনোর উৎসাহের চোটে আমি হাওয়াই চটি পায়ে গলিয়েই ছুটেছি।আর,ঐখানেেই পাহাড়ি কাঁকড়া
বিছের আনাগোনা দেখেছে বুবলাদা।কী আর করা!কপালে বকুনি ছিলো।বেশ খানিকক্ষণ সময় কেটে
গেছে,আমরা খোলা আকাশের নিচে,খুব শীত করতে থাকায় গুটিগুটি পায়ে ঘরের পথ ধরলাম আমরা ।
রান্নাঘরের কাছাকাছি
পৌঁছোতে কয়েকজনের কথাবার্তা কানে এলো,আর নাকে এলো রান্নার খোশবাই।কৌতূহলী হয়ে
রান্নাঘরে উঁকি দিলাম।দেখি,রান্নাঘরের দরজার দিকে পিঠ ক'রে নিচু একটা চারপাইয়ায়
সূরয সিং বসে,সামনে খোলা রামায়ণ আর পাশে রামের বোতল।কয়েকজন ধোপদুরস্ত 'ভদ্রলোক'
সামনে বসে।রামায়ণ গান শুনছেন।ওদিকে চুলোয় কাঠের আগুনে মুরগির মাংসের কড়ায় টগবগিয়ে
ঝোল ফুটছে আপন মনে।ব্যাপার দেখে রাতের খাওয়া দাওয়াটা কেমন হবে এসব আলোচনা করতে
করতে ঘরে ফিরে চললাম।ঘরে ঢুকেই টের পেলাম বালিশ-বিছানা সব কাল ঠাণ্ডা।দেখে শুনে
মনটা চা চা করে উঠলো।সৌরভ খুব ভালো চা তৈরি করতে পারে,আমরা তিনজন তাই ওকে ধ'রে
পড়লাম চা খাওয়াার আর্জি নিয়ে।ইলেকট্রিক কেটলি নিয়ে ও লেগে পড়লো চা তৈরি করতে আর
আমরা আমাদের সংগ্রহে থাকা বিস্কুট,চানাচুর,কাজু এসব নিয়ে বসে পড়লাম।গরম চায়ের
সঙ্গে আড্ডা জমে উঠলো।ম্যারাথন আড্ডা,হা হা হি হি'র ফাঁকে ফাঁকে পর্দা সরিয়ে পাহাড়
আর রূপোলি রাংতা মোড়া গোল চাঁদ দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কখন পেরিয়ে গেছে।হঠাৎ হঠাৎ
ঘরের মধ্যেও ঠান্ডাটা বেশ কামড় বসাচ্ছে বুঝতে পারছি।ঘড়িতে তখন ন'টা।এই হাজার দশ
ফুট উঁচু পাহাড়ি গ্রামের পক্ষে রাত ন'টা বেশ রাতই বটে!খিদেও পেয়েছিলো বেশ।এবার
নিচে গিয়ে খোঁজ পাতা করা দরকার।নিদেন পক্ষে 'খানা লাগাতে' বলতে হবে।শুরু হ'ল ঠেলাঠেলি।এ ওকে,সে
তাকে ঠেলতে ঠেলতে শেষতক আবার সৌরভকে পাকড়ে রাজি করানো গেলো।ও দরজা খুলে বেরিয়ে
গেলো।মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে এসে ঢুকে পড়লো।আমরা কী হ'ল,কী হ'ল করে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়লাম।ও কেবল বলছে,মাইনাস চার!আমরা মোটেও পাত্তা দিচ্ছি না,বিশ্বাসই তো
করিনি,বলে--মাইনাস চার!এবার আমি আর বুবলাদা দরজা খুলে বেরোলাম।দরজা খুলেই ডানদিকের
দেওয়ালে থার্মোমিটার,আর তাতে--মাইনাস চার!!!!আমরাও দুদ্দাড়িয়ে ঘরে।ঘরে ঢুকে
দেখলাম,সৌরভ দুটো লেপের তলায় আর সংঘমিত্রাদি ততক্ষণে (আমাদের মধ্যে সবচেয়ে
শীতকাতুরে) দুটো লেপের তলায় স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে সেঁধিয়েছে।কিন্তু নিচে গিয়ে
সূরয সিংকে খাবার দিতে বলাটাও জরুরী।ঠিক এমনি সময় দরজায় ধাক্কা,বুবলাদা দরজা
খুলতেই ঘরের ভেতর সূরয সিংতখন তাঁর মুখে মিটি মিটি হাসি,চোখ ঢুলু,গলায় পাহাড়ি
সুরের গুনগুন,সর্বোপরি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একটু একটু দুলছেন,জানালেন ডাইনিংয়ে খাবার
দেওয়া হয়েছে।আমাদের ঘর থেকে শুধু ওঁর বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।বুবলাদা ওর নিজস্ব হিন্দিতে ব'লে
উঠলো--"সূরয সিং টলটলায়া গিয়া"।এতক্ষণের চেপে রাখা হাসি আর আটকানো গেলো
না।এই সূরয সিং জীই এখন আমাদের খাবার পরিবেশন ক'রে খাওয়াবেন,কেমন হবে
ব্যাপারখানা,সেটা ভেবেই আমরা হেসে কুটিপাটি।যা হোক,খুবই সুস্বাদু খাবার দাবার,ভালো
ভাবেই মিটলো সে পর্ব।টুকটাক আলাপচারিতার মধ্যেই জানা গেলো,রান্নাঘরে যাঁদের
দেখেছিলাম,তাঁরা দিল্লিবাসী আপেল ব্যবসায়ী,মোটামুটি সারা বছরই এ অঞ্চলে
আনাগোনা।রাস্তার লাগোয়া ঘর দুটোয় তাঁরা আছেন।
পরদিন দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা গেলাম
ছিটকুল।তখন ওখানে একটিও হোটেল ছিলো না।ছোট্ট গ্রাম,কয়েকঘর বাসিন্দা,একটিমাত্র
দোকান,গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ঐ দোকানটিই
ভরসা।আলু,পেঁয়াজ,তেল,বিস্কুটের সঙ্গে কিছু 'আংগ্রজি দাওয়া'ও মেলে সেখানে।আমরা
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম সীমান্তের দিকে,পৌঁছে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে হু হু হাওয়া
সামলে ফিরে চললাম।সন্ধের মুখে রকছামে পৌঁছে গেলাম।পরেরদিনটাও বেশ হাসি মজায় কাটিয়ে
দিলাম।তারপরদিন আমাদের মানালি ফেরার কথা।
দেনাপাওনা মিটিয়ে রওনা হওয়ার পালা।সূরয সিংয়ের হাতে
কোনও খাতা পত্র নেই।এ ক'টা দিন অনেক কাপ চা খেয়েছি ।সে বাবদ কত টাকা দিতে হবে,জিগ্যেস
করায়,তিনি হাসি মুখে জানালেন,কোনও হিসেব তিনি রাখেননি।আমরা তো 'থ'।তাড়াতাড়ি আমাদের
'খাজাঞ্চি বাবু' সৌরভ তার হিসাব-কিতাব বার ক'রে গুনে গুনে টাকা মিটিয়ে দিলো।ভাবতে ভাবতে
রওনা দিলাম--এত সহজ সরল মনের মানুষ বোধহয় কেবল পাহাড়েই মেলে।
No comments:
Post a Comment